কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বসে বসে মধু খেয়েছেন: হাই কোর্ট

অবসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড-পিএলএফএসএলের খেলাপি ঋণ উদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2021, 05:21 PM
Updated : 23 Feb 2021, 05:23 PM

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে বসে ‘মধু খেয়েছেন’ বলে মন্তব্য এসেছে হাই কোর্টের একটি একক বেঞ্চ থেকে।

পিএলএফএসএল থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া কয়েকজনের বক্তব্য শোনার এক পর্যায়ে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, “আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের জন্য দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেখানে বসে বসে মধু খেয়েছেন। এই সমস্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পি কে হালদারসহ ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়েছেন।”

পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদারের ওরফে পিকে হালদারের কেলেঙ্কারিতে নাম আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম এবং সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

পিকে হালদারের দুই সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক এবং পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানেও এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম এসেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ আমানতকারীর আবেদনে হাই কোর্ট গত ৫ জানুয়ারি এস কে সুর চৌধুরীসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

পিএলএফএসএল থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, এমন ২৮০ জন ঋণ গ্রহীতাকে গত ২১ জানুয়ারি তলব করে হাই কোর্ট।

ফাইল ছবি

পিএলএফএসএলের সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিকুইডেটর) মো. আসাদুজ্জামান খানের দেওয়া তালিকা দেখে এ আদেশ দেয় আদালত।

তলবের পাশাপাশি ওই ২৮০ জনকে সশরীরে হাজির হয়ে ঋণ খেলাপের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সে মর্মে কারণ দর্শাতে বলে হাই কোর্ট।

কারণ দর্শানোর জন্য ২৮০ জনকে দুই ভাগে ভাগ করে ২৩ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

প্রয়োজনে তাদের গ্রেপ্তার করে আনা হবে

মঙ্গলবার ১৪৩ জনের হাজির হওয়ার কথা থাকলেও হাজির হন ৫১ জন। আগামী বৃহস্পতিবার ১৩৭ জনের হাজির হওয়ার আদেশ রয়েছে।

তলব অনুযায়ী ১৪৩ জন হাজির না হওয়ার বিষয়টি নজরে এলে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার বলেন, আদালতের তলবে যারা আসেননি, তাদের আরেকবার সুযোগ দেওয়া হবে। এরপরও তারা আদালতে হাজির না হলে প্রয়োজনে তাদের গ্রেপ্তার করে আনা হবে।

আগামী ৯ মার্চ তাদের আসতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

আদালতে ঋণ খেলাপিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী গাজী মোস্তাক আহমেদ, আইনজীবী মাসুদ হাসান চৌধুরী পরাগ, আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন, মো. তসাদ্দের রায়হান খান।

পিএলএফএসএলের সাময়িক অবসায়ক মো. আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মেজবাহুর রহমান। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজিব উল আলম ও খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।

মঙ্গলবার হাজির হওয়া ঋণ খেলাপিদের মধ্যে কয়েকজন ঋণ পরিশোধে আদালতের কাছে সময় চান। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তারা পিএলএফএসএলের কাছ থেকে ‘কোনো ঋণ নেননি’।

বাংলাদেশ ব্যাংককিছুই করেনি’ 

শুনানির এক পর্যায়ে বিচারক বলেন, “এখানে (আদালতে) এসেছেন, অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে চান। কিন্তু আদালত তো এই টাকা নিতে পারবে না। সে কারণে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করা প্রয়োজন। কিন্তু গত দুই বছর তারা কিছুই করেনি। যে কারণে আমি তাদের তলব করতে বাধ্য হয়েছি।”

তিনি বলেন, “সম্প্রতি এন আই খানকে পিএলএফএসএলের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর তিনি প্রায় একশ কোটি টাকার মত উদ্ধার করেছেন। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করা আদালতের কাজ না। বাংলাদেশ ব্যাংক হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।”

দুদক কী করেছে?

দুদকের ভূমিকায় উষ্মা প্রকাশ করে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার বলেন, “২০১৯ সালের জুন মাসে পিএলএফএসএলের বিষয়ে আদেশ দিলাম। আরেক দিকে দুদক কিংবা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট তাদের (পি কে হালদারসহ পিএলএফএসএলের অর্থ পাচারকারীদের) ধরবে। কিন্তু দুদক গত বছর জানুয়ারিতে এসে জানাল, পি কে হালদার পালিয়ে গেছে। এই সাত মাস দুদক কী করেছে?”

বিচারক বলেন, “আমরা দেখছি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সচল রেখে টাকা উদ্ধার করা যায় কি না। আমানতকারীরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। আমরা ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। একটি কোম্পানি অবসায়ন করতে হলেও তার একটা প্রক্রিয়া আছে। আমরা সেটাও দেখছি। একটা পথ বের করার চেষ্টা করছি।”

গভর্নর, দুদক বিএসইসি চেয়ারম্যানের বক্তব্য শুনবে আদালত

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধে সমন্বিতভাবে কীভাবে কাজ করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের মতামত জানতে চেয়েছে আদালত।

সেজন্য আগামী ৯ মার্চ আদালতের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে তাদের যুক্ত হতে বলা হয়েছে।

আইনজীবী মেজবাহুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত প্রথমে আগামী বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে জুম প্ল্যাটফর্মে তাদের যুক্ত হতে বলেছিলেন। কিন্তু পরে তারিখের পরিবর্তন হয়েছে। আগামী ৯ মার্চ তারিখ রাখা হয়েছে। ওই দিন ঋণ খেলাপি যারা আজকে আসেননি তাদেরকেও আসতে বলা হয়েছে।”

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ বলেছেন, তারিখ পরিবর্তনের কথা তিনি জানেন না।

“আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত যে বক্তব্য শুনবেন, সে আদেশটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়ের কাছে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। পরে তারিখ পরিবর্তন হয়েছে কি না বলতে পারব না।”

১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপিই ৭৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হার ৬৬ শতাংশ।

২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান দেয় ওই কোম্পানি। খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পারায় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারেনি তারা।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিনই মামলার শুনানি শেষে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।

এছাড়া অবসায়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজনকে অবসায়ক নিয়োগ দিতে বলা হয়।

পরে সাময়িক অবসায়ক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান খানকে নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপর আদালত পিপলস লিজিংয়ের ঋণ গ্রহীতাদের একটা তালিকা চায় সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুডেটর) মো. আসাদুজ্জামান খানের কাছে।

নির্দেশ অনুযায়ী গত বছর ২৩ নভেম্বর প্রায় ৫০০ জন ঋণ গ্রহীতার একটি তালিকা দাখিল করা হয়। সে তালিকা দেখার পর গত ২১ জানুয়ারি আদালত ২৮০ জনকে তলব করে।

অবসায়ক আসাদুজ্জামানের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ২৮০ জন ঋণ খেলাপি লিজ ফাইন্যান্স (পাঁচ বছর মেয়াদি ঋণ), লিজ ফাইন্যান্স (পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদের ঋণ), টার্ম লোন (পাঁচ বছর মেয়াদি ঋণ), টার্ম লোন (পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদের ঋণ), হোম লোন (পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদের ঋণ) ও মার্জিন লোনসহ মোট ছয় ধরনের ঋণ নিয়েছেন।

তার মধ্যে লিজ ফাইন্যান্সে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ কোটি ১৫ লাখ ৮ হাজার ৪৭১ টাকা। লিজ ফাইন্যান্সে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৭ কোটি ৮১ লাখ ৯৬ হাজার ২৮৮ টাকা।

টার্ম লোনের (পাঁচ বছর মেয়াদি ঋণ) খেলাপি ৮৭৭ কোটি ৩৭ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭১ টাকা, টার্ম লোনের (পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদের ঋণ) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ কোটি ৩০ লাখ ৫ হাজার ৭৭৬ টাকা।

হোম লোনের (পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদের ঋণ) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭ কোটি ৯৬ লাখ ২৮ হাজার ১৪৩ টাকা। আর  মার্জিন লোনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৪৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫৮ হাজার ১৩ টাকা।

মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।