হিসাবে খেলাপি ঋণ কমল, প্রশ্ন থাকল

বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা কমে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে বলে তথ্য দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2020, 05:39 PM
Updated : 30 Nov 2020, 06:41 PM

বিশেষ সুবিধা ও ছাড়ের কারণে এই নয় মাসে নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। কিছু উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে কিছু ঋণ শোধ করেছেন। তার ফলেই খানিকটা কমেছে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন ‍তুলেছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তার ভাষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ‘মিনিংলেস’ তথ্যে দেশবাসী হচ্ছে ‘বিভ্রান্ত’, তা ব্যাংক খাতের জন্য আনছে বিপদ।

ঋণ খেলাপিদের একটার পর একটা সুবিধা দিয়ে বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ আটকে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক খাতে বিপর্যয় ডেকে আনছে বলে মনে করছেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

খেলাপি ঋণের চিত্র

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোমবার খেলাপি ঋণের সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।

এই অঙ্ক মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। জুন শেষে তা ছিল ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। মার্চ মাস শেষে ছিল ৯ দশমিক ০৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক

জুন মাস নাগাদ দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।

গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর- এই ছয় মাসে প্রণোদনার ঋণ ছাড়া কোনো ঋণ বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। ঋণ বিতরণ যেটা বেড়েছে, সেটা আসলে প্রণোদনার ঋণের কারণেই বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সোয়া বছরে প্রকৃতপক্ষে কোনো খেলাপি ঋণ আদায় হয়নি।

গত বছরের ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেয় সরকার।

‘বিশেষ’ ওই সুবিধার আওতায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলো নবায়ন করেছে। এর অর্ধেকই করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েও গত বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে লাখ কোটি টাকার মতো পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

এর বাইরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করেছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে এই অর্থ বাদ যাবে, যদিও তা আর ফেরত আসছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আরেক তথ্যে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন।

ফলে ঋণ খেলাপি হিসেবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো।

এই সব খেলাপি ঋণ যোগ করলে দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো।

চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে শুরু হয় মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এই সঙ্কটকালে ঋণ খেলাপিদের আরও সুবিধা দিয়েছে সরকার; আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হচ্ছে না কাউকে।

অর্থাৎ ২০২০ সালজুড়েই কোনো ঋণের শ্রেণিমান পরিবর্তন করা যাবে না। যে ঋণ যে শ্রেণিতে আছে, সে অবস্থাতেই থাকবে। যদি কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ঋণের কিস্তি বা খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে চায়, তাহলে করতে পারবে।

এর মানে হচ্ছে, এই এক বছর কেউ কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি; যে ঋণ যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতে আছে। এক হাজার ৬৭৭ কোটি টাকার যে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে, সেটা কিছু উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগেই দিয়েছে।

‘কম দেখানোয় কী মজা, মাথায় ঢোকে না’

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিচ্ছে, আসল অঙ্ক এর আড়াই গুণ বেশি।

“এ ধরনের মিনিংলেস তথ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে। এতে আমাদের ব্যাংকিং খাতের ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে।”

আহসান এইচ মনসুর

“ঋণ আদায় না করে, ঋণ খেলাপিদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী মজা পাচ্ছে, তা আমার মাথায় ঢোকে না,” বলেন অর্থনীতির এই গবেষক।

ঋণ খেলাপিদের বার বার ছাড় দিয়ে ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বছরের নভেম্বরে যে প্রতিবেদন দিয়েছিল, তাতে ‘আসল জায়গায় আঘাত’ করা হয়েছিল বলে মত জানান আহসান মনসুর।

আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ঋণ গ্রহীতারা।

“আমি ভেবেছিলাম, আইএমএফের ওই রিপোর্টের পর সরকারের কিছুটা হলেও টনক নড়বে। কিন্তু এখন দেখছি, কিছুই হয়নি,” বলেন আহসান মনসুর।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ব্যাংকিং খাতে আসলে এক ধরনের অরাজকতা চলছে।”

ঋণ খেলাপিদের নানা সুযোগ দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার ঋণ খেলাপিদের একটার পর একটা সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অবস্থা যে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, সে দিকে কোনো নজর নেই।

“হাতেগোনা চিহ্নিত কয়েকজন লোককে সুযোগ দিতে দিনের পর দিন ছাড় দিয়েই যাচ্ছে সরকার, যার ফলশ্রুতিতে ব্যাংকিং খাতের বারোটা বাজছে।”

“এই যে করোনাভাইরাসের অজুহাত দেখিয়ে একটার পর একটা সুবিধা নিয়ে বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ শোধ করছে না কেউ, আদৌ এই টাকা আদায় হবে কি না, তা নিয়ে আমার সংশ্রয় আছে “ বলেন তিনি।