আমদানি কমায় নতুন শঙ্কা

করোনাভাইরাস মহামারীতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়লেও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক আমদানি আশঙ্কাজনকভাবে কমছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2020, 04:01 PM
Updated : 26 Nov 2020, 12:57 PM

মহামারীর আগে প্রতি মাসে পণ্য আমদানিতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হলেও এখন তা তিন বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর তাতে বিনিয়োগে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা; যার ফল হবে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার আমদানি সংক্রান্ত সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) বিভিন্ন পণ্য আমদানি জন্য ৭৩৬ কোটি ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের ওই দুই মাসে ৯৫০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।

এ হিসাবে দুই মাসে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, খাদ্য পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্যের এলসি খোলার পরিমাণই কমেছে।

শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ।

গত বছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৯৯ কোটি ২৮ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এই বছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে তা ৭৪ কোটি ৫২ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।

শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য গত বছর ওই দুই মাসে ৩২০ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এবার খোলা হয়েছে ২৮৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। শতকরা হিসাবে আমদানি কমেছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

একইভাবে শিল্প খাতের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ৫৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের কমেছে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-অগাস্ট সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৮ শতাংশ। গত বছরের এই দুই মাসে যেখানে ৮৯৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল, এবছর একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৩৬ কোটি ডলারের এলসি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমদানি কমে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ মনে করছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, রপ্তানি আয় বাড়ায় অর্থনীতিতে এক ধরনের ‘স্বস্তি’ বিরাজ করছে। কিন্তু এ সব সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমদানি বাড়ছে না; উল্টো অনেক কমছে। এটা ‘চিন্তার বিষয়’।

“আমদানির এই দৈন্যদশার প্রভাব পড়বে দেশের বিনিয়োগে। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছিল; জিডিপির ৩১-৩২ শতাংশে আটকে ছিল। এখন ভবিষ্যতে বিনিয়োগের অবস্থা আরও খারাপ হবে।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আহসান মনসুর বলেন, “আমদানি কমা মানে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কমা মানে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া। সবকিছু মিলিয়ে বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়েছি আমরা। সে কারণেই আমি বার বার বলছি, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, রপ্তানি আয়ের বর্তমান ইতিবাচক ধারা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না।”

সামনের দিনগুলোতে ওই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, তার কোনো ‘নিশ্চয়তা নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ এর প্রকোপ বাড়ায় ইউরোপের দেশগুলোতে নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। আর পরিস্থিতি ভালো হলেই যে মানুষের আগের মত ক্রয়ক্ষমতা থাকবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

দীর্ঘদিন সবকিছু বন্ধ থাকার কারণে কাজকর্ম নেই। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন; কেউ আবার চাকরিতে থাকলেও ঠিকমত বেতন পাচ্ছেন না। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে চাহিদা বাড়বে না; আমদানিও বাড়বে না। অর্থনীতিতে সেই নেতিবাচক প্রভাবই পড়ছে বলে আহসান মনসুরের শঙ্কা।

“সে কারণেই সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে এখন সরকারকে। অপ্রয়োজনী খরচ যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এমন কথা ইতোমধ্যে বলেছেন। সরকারকে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে।”

মহামারীর ক্ষতি সামলে উঠতে লাখ কোটি টাকার বেশি যে প্রণোদনা প্যাকেজ সরকার ঘোষণা করেছে, দ্রুত তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

তার সঙ্গে একমত পোষণ করে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমদানি কমা সত্যিই উদ্বেগের। বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়া শিল্প খাতের জন্য তথা বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”

এখন বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য শুধু বড় বড় উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ঋণ দিলে হবে না, ছোট-মাঝারি-ক্ষুদ্র সব শ্রেণির উদ্যোক্তারা যেন এর সুফল পান, তা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে গত বছর ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর সেখান থেকে কাঁচামাল কেনা বন্ধ করে দেয় বিভিন্ন দেশ। এরপর এ ভাইরাস অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থাই হয়ে পড়ে অচল। তার প্রভাব পড়ে পণ্য বাণিজ্যে।

মার্চ মাসে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে এপ্রিল মাসে পণ্য আমদানি তলানিতে নেমে আসে। ওই মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মাত্র ১৬০ কোটি ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। যা ছিল গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২৬৮ শতাংশ কম। আর আগের মাস মার্চের চেয়ে ২৬৩ শতাংশ কম।

গত বছরের এপ্রিল মাসে ৫২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আর গত মার্চ মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪৯৭ কোটি ডলারের।

লকডাউন ওঠার পর এবার জুন থেকে এলসি খোলার পরিমাণ বাড়লেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখনও তা অনেক কম।

মে মাসে খোলা হয়েছিল ২৩৭ কোটি ডলারের এলসি। গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এই অংক কিছুটা বাড়লেও তা ছিল ৪০০ কোটি ডলারের কম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার ৬৫১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৫৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ।

আর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) আমদানি হয়েছে ৭৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কম।

অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ৯৮৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

এই তিন মাসে রেমিটেন্স হিসেবে এসেছে ৬৭১ কোটি ৩২ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

আর ওই রেমিটেন্সের উপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান করছে।

আরও পড়ুন