তিন মাসে ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি

করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুতে তলানিতে নেমে যাওয়া রপ্তানি আয় এখন প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়াচ্ছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2020, 05:12 PM
Updated : 4 Oct 2020, 05:12 PM

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রায় ১০ বিলিয়ন (এক হাজার কোটি) ডলার আয় করেছে।

এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে আরও বেশি, ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

সদ্য শেষ হওয়া সেপ্টেম্বর মাসে গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে আয় বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ।

মহামারীর এই কঠিন সময়ে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রপ্তানি আয়ের এই ইতিবাচক ধারায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

রোববার রাতে দুবাই থেকে টেলিফোনে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু রেমিটেন্স নয়, অর্থনীতির সব সূচকই এখন ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। করোনানাভাইরাস মহামারীর যে ধাক্কা আমাদের অর্থনীতিতে পড়েছিল, তা আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করে চলেছি। তার প্রমাণ রপ্তানি আয়ের এই প্রবৃদ্ধি।”

“মার্চে মহামারীর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর পরই আমাদের প্রধানমন্ত্রী রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক কারখানার শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন-ভাতা দিতে মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেন। চাহিদা বাড়লে পরে এই প্রণোদনার টাকা আরও আড়াই হাজার টাকা বাড়ানো হয়।”

“পরে পোশাক কারখানার মালিকরা আরও এক মাসের বেতনের টাকা চাইলে তিন হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর সুফল এখন আমরা পাচ্ছি,” বলেন অর্থমন্ত্রী।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রোববার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তনি করে বাংলাদেশ ৯৮৯ কোটি ৬৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার আয় করেছে।

এই তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৯৬৬ কোটি (৯.৬৬ বিলিয়ন) ডলার।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার (৯.৬৪ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই জুলাই-অগাস্ট সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে ৩০১ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে আরও বেশি; প্রায় ৬ শতাংশ।

সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮৫ কোটি ডলার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছিল ২৯১ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।

তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশের মতো। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি।

এই তিন মাসে ৮০৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৮১২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলার।

জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তৈরি পোশাকের মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪৪৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। অপরদিকে উভেন পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩৬৬ কোটি ২৭ লাখ ডলার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই তিন মাসে নিট পোশাক রপ্তানিতে ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও উভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি এভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিন যত যাচ্ছে আমরা তত সাহস পাচ্ছি। কোভিড-১৯ নিয়ে যতটা ভয় পেয়েছিলাম; সেটা আসলে এখন আর নেই।

“২৫ ডিসেম্বরের বড় দিনকে ঘিরে অর্ডার আসছে। এর বাইরেও নতুন অর্ডার আসছে। তবে এখন বেসিক আইটেমের (অতি প্রয়োজনীয়) পোশাক রপ্তানি হচ্ছে বেশি। সে কারণেই নিটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে; উভেনে কমেছে।”

তিনি বলেন, প্রতিবছর অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসটা খারাপ যায়। মহামারীর মধ্যেও এই দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের বেশি রপ্তানি হয়েছে, এটা খুবই ‘ভালো লক্ষণ’।

ডিসেম্বরের বড়দিনকে সামনে রেখে অক্টোবর থেকে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের ভরা মৌসুম শুরু হয়।

পারভেজ বলেন, “বড় বড় ফ্যাশন হাউজগুলো খুলতে শুরু করেছে। বায়ারদের কাছ থেকে আমরা যতটুকু আভাস পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে ডিসেম্বরে বড়দিনকে ঘিরে বিশ্ববাজারে পোশাক কেনাবেচা বাড়বে। আমাদের রপ্তানিও ঘুরে দাঁড়াবে।”

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যতটা ভয় পেয়েছিলাম, তা এই তিন মাসে কেটে গেছে। এখন আমরা সাহস পাচ্ছি।

“শ্রমিকদের বেতন দিতে সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তাতে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। সবমিলিয়ে ছয় মাস-এক বছরের মধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব বলে আশা করছি।”

করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছিল; ওই মাসে সবিমিলিয়ে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩৬ কোটি ডলার।

বিধি-নিষেধ শিথিলে কারখানা খোলার পর মে মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ে, জুনে তার চেয়ে অনেক বাড়ে।

এরপর নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ৫৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

জুলাই মাসের ওই আয়ের মধ্য দিয়ে সাত মাস পর রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসে বাংলাদেশ।

দ্বিতীয় মাস অগাস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে একটি বিষয় কিন্তু আমাদের সবার মনে রাখতে হবে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব শুরু হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু আমাদের রপ্তানি আয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিল। প্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি কমছিল।

“তিন মাসে আড়াই শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মহামারীর সময় প্রবৃদ্ধি থাকাই বড় বিষয়।”

পাটের তৈরি এসব পণ্য রপ্তানিও হয়। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

পাট রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ৩৯.২৬%

এই সঙ্কটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির বড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১২ শতাংশের মতো।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে, যা ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

অন্যান্য পণ্য রপ্তানি

মহামারীকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ২১ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ২৩ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ।

তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে চলতি অর্থবছরে ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০) মার্কিন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করে, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ছিল ২৬ শতাংশ।