বাণিজ্য ঘাটতি ১৮ বিলিয়ন ডলার

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে পণ্য বাণিজ্যে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছে গত অর্থবছর।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2020, 06:31 PM
Updated : 28 July 2020, 06:31 PM

এই ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।

বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবে ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছে বছর।

বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ যাওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট পাঁচ হাজার ৬৯ কোটি ১০ লাখ (৫০.৬৯ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ।

আর রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে তিন হাজার ২৮৩ কোটি (৩২.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮৬ কোটি ১০ লাখ (প্রায় ১৮ বিলিয়ন) ডলার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ। আর আমদানি খাতে ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম অর্থনীতির অন্যতম প্রধান দুই সূচক আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় দুটোই কমেছে। এর আগের বছরগুলোতে কখনও কখনও রপ্তানি আয় হোঁচট খেলেও আমদানি ব্যয় বরাবরই বেড়েছে।

অর্থবছরের শেষের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কায় রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমার এই উল্টো চিত্র, বলছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, এ কারণে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টেও (বিওপি) বড় ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়েছে।

আমদানি কমায় গত অর্থবছরের তিন মাস পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে কম ছিল।

২০১৮-১৯ অর্থছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৩৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই একই সময়ে ঘাটতি ছিল তার থেকে কম ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তবে রপ্তানি আয়ে ধসের কারণে এরপর থেকেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকে, এমনকি আমদানি ব্যয় কমার পরও বাড়ে এই ঘাটতি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে; ১৮ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পণ্য বাণিজ্য ও ব্যালান্স অফ পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে এটা অবধারিতই ছিল। কোভিড-১৯ মহামারীর আগেও রপ্তানিতে বেশ খারাপ অবস্থা ছিল। মহামারীর পর দুই সূচকেই বড় ধাক্কা লেগেছে।

“তাও তো ভালো এই মাহামারীকালেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স স্বস্তি এনে দিয়েছে।”

সেবা খাতে ঘাটতি ৩ বিলিয়ন ডলার

সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি সামান্য কমেছে। গত অর্থবছরে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের এই ঘাটতি ছিল ৩১৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ৫ বিলিয়ন ডলার

২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৮৪ কোটি ৯০ লাখ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৫১০ কোটি ২০ লাখ (৫.১ বিলিয়ন) ডলার।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

গত অর্থবছরের অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ।

অর্থবছরের নয় মাস শেষে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত

তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ৩৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়েছে।

আগের অর্থবছরের এই ঘাটতি ছিল ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ৮ বিলিয়ন ডলার

আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে শেষ হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, তথ্যে গত অর্থবছর শেষে এই উদ্বুত্ত দাঁড়িয়েছে ৭৯৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই উদ্বৃত্ত ছিল ৫৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অর্থবছরের শেষ দিকে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা মোটা অংকের ঋণ সহায়তা দেওয়ায় আর্থিক হিসাবে বেশ ভালো উদ্বৃত্ত ছিল বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

ঋণ বেড়েছে ১১.৭ শতাংশ

গত অর্থবছরে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ৬৯৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আগের বছরের এসেছিল ৬২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে গত অর্থবছরে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছ ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।

রেমিটেন্স বেড়েছে ১১ শতাংশ

মহামারীর মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েছে। গত অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আগের অর্থবছরে এসেছিল এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার।

শতাংশ হিসেবে রেমিটেন্স বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

এফডিআই কমেছে ৩৬ শতাংশ

গত অর্থবছরের মতো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা আর নেই।

২০১৮-১৯ অর্থছরের ৪৯৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে এসেছে ৩১৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে এফডিআই কমেছে ৩৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আগের বছরে এসেছিল ২৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে নিট এফডিআই কমেছে ৩১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে সামান্য

২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ২৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) এসেছে। গত অর্থবছরে এসেছিল ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।