১১ মাসে ১৬০৭ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি

করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি যখন তলানিতে, অর্থবছরের ১১ মাসের হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬০৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2020, 06:00 PM
Updated : 28 June 2020, 06:22 PM

ঘাটতির এই পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি; আর পুরো অর্থবছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ের বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবে ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

তাতে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট চার হাজার ৬২৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে তিন হাজার ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর পুরো বছরে (জুলাই-জুন) ঘাটতি ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

আমদানি কমায় বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে কম। কিন্তু রপ্তানি আয়ে ধসের কারণে এরপর থেকে ঘাটতি বাড়তে থাকে।

মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করে। তখন রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে। কিন্তু ঘাটতি আর কমেনি।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, চলতি জুন মাসের তথ্য এর সঙ্গে যোগ হলেও শেষ পর্যন্ত রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি নিয়েই হয়ত অর্থবছর শেষ হবে বাংলাদেশকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৮ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার, সেটা এ যাবৎকালের রেকর্ড। আর বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার।

“কঠিন সঙ্কটের এই সময়ে বছরের শেষ মাস জুনে রপ্তানি আয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। আমদানিতেও ধীর গতি থাকবে। হিসাব করে বলা যায়, জুন মসে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হবে। আর সেটা হলে এবার বাণিজ্য ঘাটতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই ১১ মাসে আমদানি ব্যয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ কমেছে। আর রপ্তানি আয় কমেছে ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

তবে সেবা খাতে বাণিজ্য ঘাটতি এবার কিছুটা কমেছে। জুলাই-মে সময়ে এ খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৭৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ২৯৫ কোটি ডলার ছিল।

মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতি বাড়ছে বাংলাদেশের। বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে এখনও উদ্বৃত্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ১৬৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছরের ১১ মাস শেষ হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।

আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) জুলাই-মে সময়ে ৫২৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৫০৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

মহামারীর মধ্যেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ না কমায় সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্য এবং আর্থিক হিসাবে এই উদ্বৃত্তি রয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

জুলাই-মে সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ৪৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আগের বছরের এই ১১ মাসে এসেছিল ৪৯৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই ১১ মাসে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমেছে দশমিক ৭৪ শতাংশ।

মহামারীর মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এক হাজার ৫০৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পাঠিয়েছেন এক হাজার ৬৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ১১ মাসের হিসাবে রেমিটেন্স বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

তবে গত অর্থবছরের মত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা এবার আর নেই।

২০১৮-১৯ অর্থছরের জুলাই-মে সময়ে ৪৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩৭২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১১ মাসের হিসাবে এফডিআই কমেছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এবার জুলাই-মে সময়ে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই সময়ে এসেছিল ২৪২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে নিট এফডিআই কমেছে ১৯ শতাংশ।

এই ১১ মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) এসেছে তার থেকে চলে গেছে বেশি।

গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পুঁজিবাজারে ১৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। এবার এই ১১ মাসে যে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তার থেকে ৭০ লাখ ডলার বেশি চলে গেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।