করোনাভাইরাস তহবিলের টাকা গার্মেন্ট মালিকরা পাবেন ঋণ হিসেবে

নভেল করোনাভাইরাসের বিশ্ব সঙ্কটে বিপর্যয়ের মুখে পড়া রপ্তানিমুখী খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে সরকার যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে, তা ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ হিসেবে পাবেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2020, 04:24 PM
Updated : 1 April 2020, 04:24 PM

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই অর্থের যোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে যে অর্থের প্রয়োজন তা জানিয়ে গার্মেন্ট মালিকরা ব্যাংকের কাছ থেকে ২ শতাংশ হার সুদে ঋণ নিতে পারবেন ওই তহবিল থেকে।

এই ঋণের গ্রেস পিরিয়ড হবে ছয় মাস। অর্থাৎ, ঋণ নেওয়ার পর প্রথম ৬ মাস তাদের কিস্তি দিতে হবে না। ঋণের পুরো অর্থ শোধ করতে তারা দুই বছর সময় পাবেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য বলছেন, ওই ২ শতাংশ অর্থ আসলে সুদ না, সার্ভিস চার্জ।

বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণ ও আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোর যে খরচ হবে, সেজন্যই ওই ২ শতাংশ ‘সার্ভিস চার্জ’ নেওয়া হবে।

অর্থমন্ত্রী মঙ্গলবার নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সেখানে এই ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণের একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়, যা অর্থমন্ত্রণালয় বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে।

বৃহস্পতিবার নীতিমালাটি সার্কুলার আকারে জারি করা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ-এর সভাপতি রুবানা হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এই টাকা কেবল শ্রমিক এবং এ খাতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনে-ভাতাতেই ব্যয় করা যাবে।”

ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে শুরু হওয়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পুরো বিশ্বেই ব্যবসা বাণিজ্য একপ্রকার স্থবির হয়ে আছে। চীন পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠে কারখানা খোলার চেষ্টায় থাকলেও ইউরোপ আমেরিকার মানুষ এখন কার্যত অবরুদ্ধ দশায় দিন কাটাচ্ছে।

বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এখনও ততটা বেশি না হলেও সংক্রমণ এড়াতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, বন্ধ রয়েছে যানবাহন চলাচল।

আর যেসব দেশ বাংলাদেশের পোশাক কেনে, তারাই এ মহামারীতে সবচেয়ে বেশি নাজুক দশায় পড়ায় প্রতিদিনই ক্রয় আদেশ বাতিল করছেন ক্রেতারা, যা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের খাতে ডেকে আনছে সর্বনাশ।  

বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪ হাজারের মত গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এ শিল্পে কাজ করছেন ৪০ লাখের মত শ্রমিক, যাদের বড় অংশই নারী।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ যত টাকার পণ্য ও সেবা বিদেশে রপ্তানি করেছে, তার ৮৪ শতাংশ এসেছে এই পোশাক খাত থেকে। আর করোনাভাইরাস সঙ্কট শুরুর পর গত তিন মাসে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশ ক্রেতারা বাতিল বা স্থগিত করেছেন বলে রুবানা হকের ভাষ্য।

# রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ (২৬.২৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

এই অংক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।

# জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

# এই ছয় মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

# গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ; মোট আয়ের ৮৪ শতাংশের মত এসেছিল তৈরি পোশাক শিল্প থেকে।

# ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও তার অনেক পেছনে থাকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের কারণে। 

এই পরিস্থিতিতে গত ২৫ মার্চ জাতির জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানিমুখী খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন।

অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই তহবিলের জন্য বাজেট থেকে টাকা না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। তার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গার্মেন্ট মালিকদের ঋণ দেবে।

“সরকার এখানে কোনো ধরনের সুদ নেবে না। যে ২ শতাংশ সুদ শিল্প মালিকদের কাছ থেকে নেওয়া হবে, তা ঋণ বিতরণকারী ব্যাংক সার্ভিজ চার্জ হিসেবে রাখবে।”

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় কথা আসছে রপ্তানিমুখী শিল্পে সরকার দান দিচ্ছে। এটি দান নয়, ২ শতাংশ সুদে লোন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে যা সময়ের ব্যবধানে শোধ করতে হবে।”

পোশাক শিল্প ছাড়াও অন্য কোন কোন খাত করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কি ধরনের সহায়তা প্রয়োজন তা নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠক হবে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।