‘কারখানা খুললে কাজ মিলবে তো?’

বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাক শিল্প, যেখানে সিংহভাগই নারী শ্রমিক।

সুমন মাহমুদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2020, 11:37 AM
Updated : 31 March 2020, 11:37 AM

পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা এনে দিতে যারা উদায়াস্ত পরিরশ্রম করতেন, সেই নারীরাই এখন কর্মহীন, ঘরবন্দি। কারখানা বন্ধের এই সময়ে তিনবেলা খাবার, ঘরভাড়া জোটানোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের ভবিবষ্যতের দুশ্চিন্তাও। কারখানা কবে খুলবে, খুললেও কাজ মিলবে কিনা- সেসব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে।

“চিন্তায় ঘুম হয় না স্যার, কী করমু জানি না,” মঙ্গলবার মালিবাগে এভাবেই নিজের দুশ্চিন্তার কথা জানান নীলফামারীর আলেয়া।

বছর তিনেক আগে ঢাকায় এসে মালিবাগের যে গার্মেন্টে কাজে ঢুকেছিলেন সেটি ২৪ মার্চ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ১০ দিন আগেও আলেয়ারা সকাল ৮টায় পায়ে হেঁটে রামপুরায় তাদের কর্মস্থলে ছুটে গেছেন, বিকালে শিফট শেষ করে ফিরেছেন বাড্ডার টিনশেডের বাসায়।

কেন এই উদ্বেগ- জানতে চাইলে আলেয়া বলেন, তার ধারণা পোশাক খাতে কাজ কমে যাবে।

“কি করমু বুঝতে পারতেছি না। গ্রাম ফেরা যাচ্ছে না, একটা ঘরে কতক্ষণ থাকা যায়? কবে গার্মেন্টস খুলব কে জানে? খুললেও কাজ পামু কিনা কে জানে? না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এভাবে কয়দিন বেকার থাকমু, কামাই ছাড়া ঢাকায় থাকমু কেমনে।”

আলেয়ার রিকশাচালক স্বামী আবদুর রউফও সাতদিন ধরে বলতে গেলে ঘরে বসা। সোমবার রিকশায় নিয়ে বের হলেও মাত্র ৮৬ টাকা রোজগার করতে পেরেছেন বলে জানান আলেয়া।

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর গত রোববারের তথ্য অনুযায়ী, বন্ধ হয়ে গেছে ৮০ শতাংশ কারখানা। কিছু কারখানা চিকিৎসা সামগ্রী তৈরি ও জরুরি বিদেশি ক্রয়াদেশ বাস্তবায়নের কাজ করছে।

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর অধীনে ৩২০০ পোশাক কারখানা রয়েছে। এই হিসাবের বাইরেও অনেক কারখানা রয়েছে যারা এসব কারখানার হয়ে পোশাক তৈরি করে দিয়ে থাকে।

বিজিএমইএর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এক হাজার ৮টি কারখানায় প্রায় তিন বিলিয়ন (২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন) ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল কিংবা স্থগিত করা হয়েছে। ফলে এসব কারখানার ২০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

রপ্তানিমুখী নিট পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বিকেএমইএ সদস্য কাখানাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। বিকেএমইএর অধীনে দুই হাজার ২৮৩টি কারখানা রয়েছে, যেগুলোতে কর্মরত আছেন অন্তত ২৫ লাখ শ্রমিক।

পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন শিল্পের সিংহভাগ নারী শ্রমিক নারী। বর্তমান সময় নিয়ে যেমন থাদেরকে ভাবতে হচ্ছে, তেমনি কারখানাগুলো কবে খুলবে, খুললেও কাজ পাবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে তাদের।

সঙ্কটময় এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিখাতের শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা কখন, কিভাবে দেওয়া হবে তাও জানেন না শ্রমিকরা।

সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত, বাড়নো হয়েছে মঙ্গলবারই। সবমিলিয়ে নারী পোশাক শ্রমিকদের দুশ্চিন্তার সময় আরও বাড়লো। 

মঙ্গলবার মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডার পথে পথে আরও কয়েকজন নারী পোশাক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে দুশ্চিন্তার কথা।

পশ্চিম মালিবাগের একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন মনোয়ারা বেগম। মালিবাগ বাগানবাড়িতে একটা ছোট একটি কক্ষে দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন বিধবা মনোয়ারা। গার্মেন্টে আয়ের টাকাতেই চলে তার সংসার। মনোয়ারার আশপাশে আরো কয়েকটি কক্ষে থাকেন কুলসুম বেগম, নাসরিন, শেফালীর মতো আরও কয়েকজন নারী শ্রমিক।

মনোয়ারা বলেণ, “আমাদের গার্মেন্টেসে বিদেশি যেসব কাজ আসত তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কারখানা খুললেও কাজ পামু কিনা জানি না। কারণ বড় স্যাররা আগেই বলে দিছেন ‘চাকরি নটের’ কথা।”

সরকারি ছুটি আরও বাড়তে পারে, এ খবরে ২৮ বছর বয়সী শেফালী বলেন, “স্যার ছুটি বাড়লে আমাগো কারখানাও তো আর খুলব না। এইভাবে কতদিন ঘরের মইধ্যে থাকমু। ঘরের বাইরে রাস্তায় হাঁটা যায় না। পুলিশে দৌড়ানি দেয়।

“কালকে আমাগো বাসার সামনে মাইকিং কইরা গেছে- কেউ যেন বাইরে না যাই।”

মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার একটি ছোট গার্মেন্টের কর্মী নাসরিন বলেন, “গ্রামে যাইতে পারতেছি না, বাড়িওয়ালাও ভাড়া ছাড়া থাকতে দিব না বইলা দিছে। প্রতি মাসে বেতন পাইয়া ভাড়া দেই। এইবার কি হইব জানি না।

“গার্মেন্টস না খুললে, চাকরি না থাকলে কিভাবে ভাড়া দিমু, কিছুই মাথায় আসতাছে না। মইরা যামু স্যার। চিন্তায় ঘুমও হয় না রাইতে।”

মঙ্গলবার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় দুঃস্থ ও গরীবদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। সেখানে নারী পোশাক শ্রমকিদেরও অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন চাল-ডাল-আলুর জন্য।

তাদের কয়েকজন খাদ্যসামগ্রী না পেয়ে আক্ষেপ করে বলেন, চাল-ডাল পেলে হয়ত দুইদিন চলতে পারতেন।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর অধিকাংশই চীনের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে চীন থেকে কাঁচামাল আসা বন্ধ থাকায় সঙ্কট যে দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে সে আভাস দিয়েছেন একজন সুতা আমাদানীকারক।

নাম প্রকাশ না করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাঁচামালের স্টক যেটা আছে সেটা একেবারেই তলানিতে পৌঁছে গেছে। ফলে একটা বড় ধরনের বিপদ আমাদের সামনে উঁকি দিচ্ছে।

“কারণ শিপমেন্ট চালু না হলে যত পদক্ষেপই সরকার নিক না কেন গার্মেন্ট শিল্পগুলো আবার পুরোদমে চলতে পারবে কিনা আমি সন্দিহান।”

কারখানা খুললেও সব শ্রমিকের কাজ থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান বিজিএমইএর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মনসুর খালেদও।

তিনি বলেন, “এ ধরনের আশঙ্কা আমাদের মধ্যেও কাজ করছে। কারণ করোনাভাইরাসের কারণে এখন বিশ্বব্যাপী পোশাকের কেনাকাটা এক ধরনের বন্ধ রয়েছে। নতুন ক্রয়াদেশ আসছেনা, উল্টো পুরোনা ক্রয়াদেশের মধ্যে অধিকাংশই বাতিল বা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে।

“এই পরিস্থিতিতে আগামী ১০/১২ দিন পর কারখানা খুললেও শ্রমিকদের জন্য কাজ থাকবেনা বললেই চলে।”