গত ২০ মার্চ শুক্রবার রপ্তানি হয়েছে পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৮০ হাজার ডলার।
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে এভাবেই কমছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়। মহামারি এই রোগের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা বন্ধের দাবি উঠেছে। রোববার শ্রম মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী দিনগুলোতে কমতে কমতে তা শূন্যে নামতে পারে বলেও আশংকা করছেন পোশাক রপ্তানিকরকরা।তারা এতটাই আতঙ্কিত যে বুঝে উঠতে পারছেন না কি করবেন?
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে এমনিতেই ছিল মন্দা; টানা চার মাস কমার পর গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৩ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
গত ৫ মার্চ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ (২৬.২৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পোশাক রপ্তানিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েনি।যেটা কমছিল, সেটা আগের মন্দার কারণেই কমছিল। কিন্তু মার্চ মাস থেকে প্রতিদিনই কমছে।
পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ মার্চ পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ৭ লাখ ১১ কোটি ৭০ হাজার ডলার। গত ১৮ মার্চ আয় করেছে ৪ কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪২ শতাংশ।
১৯ মার্চ রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার। ৯ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গত বছরের ১৯ মার্চ রপ্তানি হয়েছিল ৯ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। কমেছে ১২ শতাংশ।
আর ২০ মার্চ রপ্তানি হয়েছে ৫ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। গত বছরের ২০ মার্চ রপ্তানি হয়েছিল ৯ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪৪ দশমিক ১৫ শতাংশ।
পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক এ তথ্য জানিয়ে শনিবার বিকেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতি মিনিটে-ঘন্টায় পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এমন দুর্দিন আগে কখনও আসেনি। পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করব বুঝতে পারছি না। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরা।”
করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির সব খাতই বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি।
শনিবার ‘করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে করোনাভাইরাসকে ‘মানব ইতিহাসের ভয়াবহ সংকট’ আখ্যায়িত করে সিপিডি বলেছে, উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি, স্বাস্থ্য খাত, অর্থায়ন, পর্যটন, প্রবাসী আয়, রাজস্ব, অনানুষ্ঠানিক খাত, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সব শেষে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিজিএমইএ‘র সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুঝে উঠতে পারছি না, কী করব আমরা। প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।”
বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি পারভেজ বলেন, “এমনিতেই আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ খারাপ অবস্থা চলছিল। নানা বাধা-বিপত্তির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিলাম না। এখন করোনাভাইরাস আমাদের সবকিছু ওলট-পালট করে দিচ্ছে।”
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে এবছরের শুরুতে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ইতোমধ্যে তা বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে আড়াই লাখে।
বাংলাদেশে দুই জনসহ ১১ হাজারের বেশি মারা গেছে।
এই রোগ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পণ্য সরবরাহ ও মানুষের চলাচলও সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশ পড়েছে শিল্পের কাঁচামাল সঙ্কটে।
“সবার আগে তো জীবন ভাই! সবাই এখন কিভাবে বেঁচে থাকবেন সেই যুদ্ধ করছে। বাণিজ্য-অর্থনীতি নিয়ে কিছুই ভাবছে না কেউ। গোটা বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছে এই করোনাভাইরাস।
সুখবর নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শুরু হলেও দ্বিতীয় মাস অগাস্টে এসেই ধাক্কা খায় রপ্তানি আয়। প্রথম মাস জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল।
কিন্তু অগাস্ট মাসে গত বছরের অগাস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আসে। সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অক্টোবরে আরও বড় ধাক্কা খায়: এ মাসে কমে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। নভেম্বরে কমে প্রায় ১১ শতাংশ।
টানা চার মাস কমার পর গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৩ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু পরের মাস জানুয়ারিতে তা ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমে যায়।
আট মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৫৩%
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার; যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে আরও বেশি; ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এই আট মাসে নিট পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর উভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
হিসাব করে দেখা গেছে, এই ছয় মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।
পোশাক কারখানা বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত রোববার
মহামারি এই রোগের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা বন্ধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কয়েকদিন ধরে।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র শনিবার এক বিবৃতিতে মহামারি থেকে শ্রমিকদের বাঁচাতে সরকার ও মালিকদের সংবেদনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কবল থেকে শ্রমিকদের বাঁচাতে এবং দেশের শ্রমশক্তি রক্ষায় অবিলম্বে সবেতন ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার বিকেলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পোশাক শিল্প মালিকরা। বৈঠকে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। রোববার ফের বৈঠক হবে।
বৈঠক শেষে রুবানা হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার মালিক-শ্রমিক সব পক্ষকে নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।”