শুধু এই করোনাভাইরাসের সময় নয়, বাংলাদেশে এর আগে যত দুর্যোগ বা সঙ্কট তৈরি হয়েছে সব সময়ই অস্থির হয়েছে বাজার। আর তা ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপগুলো খু্ব বেশি কাজে আসেনি। ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে কাজ না পাওয়ায় যাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের নিয়ে সরকারকে শিগিগিরই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, দুর্যোগ দেখলে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া এই জনপদের মানুষের চরিত্রেরই অংশ। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে তার মজুদ থেকে জিনিসপত্র বের করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি বেঁধে দিতে হবে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম।
দুর্যোগ বা সঙ্কটকালে বাজার কেন অস্থির হয়ে ওঠে এবং সেই পরিস্থিতিতে করণীয় কী, এ নিয়ে মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ, অধ্যাপক আবুল বারকাত, অধ্যাপক এম এম আকাশ এবং বিআইডিএস’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ।
এটাই আমাদের চরিত্র: খলিকুজ্জামান
দুর্যোগের সময় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া অনেকের চরিত্রেরই অংশ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ।
সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের বার বার বলার পরেও ‘তাদের অভ্যাস গেল না’ উল্লেখ করে খলিকুজ্জামান বলেন, “আমরা ঠিক জাতি হিসেবে ওই রকম জায়গায় যেতে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েছি সেটাও পুরোপুরি আমরা সবাই মিলে হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না।
“কারণ স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের একটা দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে। সেটা আমরা নিতে পারছি না, আমিই চাই সব। চরিত্র নেই আমাদের, এটা মূল্যবোধের অবক্ষয়।
করোনাভাইরাসের কারণে যারা কাজ পাচ্ছেন না তাদের সহায়তায় সরকারের ঘোষণার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটা কীভাবে, কবে, কখন করা হবে সেই প্রশ্ন সামনে আসছে, এটা দ্রুত করা উচিত।”
এই বৈশ্বিক দুর্যোগে কে কাকে সাহায্য করবে সেই প্রশ্ন রেখে খলিকুজ্জামান বলেন, “আগে কখনও এ ধরনের হয়নি। এশিয়ান ফ্লু হয়েছে কিন্তু এ ধরনের এর আগে কখনো হয়েছে বলে শুনিনি। সারা বিশ্বে মানবজাতির উপর বড় ধরনের সংকট হয়ে এসেছে। এই জায়গায়ও যদি মনুষ্যত্বটাকে জাগাতে না পারি তাহলে কখন জাগাব?”
দায়ী বিকৃত মুক্তবাজার অর্থনীতি: বারকাত
বিভিন্ন দুর্যোগ ও সঙ্কটকালে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে বিকৃত মুক্তবাজার অর্থনীতিকে দায়ী করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত।
তিনি বলেন, “মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নরমালি এ রকম হওয়ার কথা না। বাংলাদেশে বিকৃত মুক্তবাজার অর্থনীতি। এর মানে হল, আসলে মুক্তবাজার বলে কিছু নেই, বিকৃত বাজারে এমন হয়ই।
“এটা হেলথ মার্কেট, এডুকেশন মার্কেট বা নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার যা-ই বলেন না কেন। সব জায়গায়ই ডিসটরটেড যদি মার্কেট হয় তাহলে এই ডিসটরশনটা ব্যবহার করা সোজা, তবে সবার পক্ষে না। কারণ একজন সাধারণ কৃষকের পক্ষে এটা সম্ভব না। তিনি কখনও বেশি দাম পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা পেয়ে যায়।
“১০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হলে আমাদের ৮০ টাকায় কিনতে হয়। মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাতে ৭০ টাকা অ্যাড হয়। কিন্তু অ্যাড হওয়া উচিত ১০ টাকা। ২০ টাকায় জিনিসটা না পেয়ে আপনাকে ৮০ টাকা দিতে হচ্ছে। কী এমন জিনিস কাজ করছে?”
“এক লাখ টাকা অন্যায় করে এক হাজার টাকা শাস্তি দেওয়া হলে তো ১০ বার অন্যায় করতে চাইবে। কারণ ওই টাকায় তো ১০০ বার জরিমানা দিতে পারবেন। খুব শক্তিশালী রেগুলেটরি কাজ করতে হবে।”
চালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে অধ্যাপক বারকাত বলেন, “দাম যেন না বাড়ে সেজন্য সরকারি গোডাউনের চাল কেন বাজারে ছেড়ে দেওয়া হল না? বাজার যখন এ রকম রেড সিগন্যাল দেয় তখন ধরে নিতে হবে বাজারে সাপ্লাই কম, ডিমান্ড বেশি। রাষ্ট্রকে তখন গুদাম থেকে চাল বের করে দিতে হবে। দামও নির্ধারণ করে দিতে হবে, না মানলে সাজা দিতে হবে।”
বারকাত বলেন, সিন্ডিকেট ও বিকৃত বাজার অর্থনীতিতে সরকারি মেকানিজম দুর্বলভাবে কাজ করে, সেটার সুযোগ তারা গ্রহণ করে।
“তেল, চাল, আটা, লবণসহ নিত্যপণ্যের ব্যবসা যারা করছেন, শুনি যে তারা খুব শক্ত, শক্তিশালী। এই সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী। যদি এমন হয় এই সিন্ডিকেট রাষ্ট্রের চাইতে শক্তিশালী তাহলে কী ধরে নেব এই সিন্ডিকেটের লোকজনই স্টিয়ারিং হুইলের মধ্যে থাকেন? তাহলে কি শস্যের মধ্যে ভূত? শস্যের মধ্যে ভূত থাকলে তাড়ানো কঠিন।”
ওএমএস, ভিজিএফসহ এ ধরনের সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি ১৭ কোটি মানুষের দেশে করা সম্ভব কি না সেই প্রশ্নও তোলেন অধ্যাপক বারকাত।
করোনাভাইরাসের আরও বিস্তুার হলে কী হতে পারে, সেই প্রশ্নে অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, “ঝুঁকি নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন কিন্তু অনিশ্চয়তা নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন না।”
তবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আরও বাড়ার শঙ্কা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে এবং তা প্রশমন করার জন্য রাষ্ট্র, সরকারকে অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বড় বিপদ।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রিভেনশন প্রধান হিসেবে একজনকে নিয়োগ দেওয়ার দাবি তুলে অধ্যাপক বারকাত বলেন, “একজনকে রেসপন্সিবল করেন, বিভিন্নজনকে সঙ্গে নিয়ে তার একটা পরামর্শক পর্ষদ থাকবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেবেন।
“পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একজন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যার (মন্ত্রণালয়, বিভাগ, প্রতিষ্ঠান) কাছে উনি যা, যখন চাইবেন তখন তা দিতে বাধ্য থাকবেন। আর না দিতে পারলে ছেড়ে যান। শুনতে স্বৈরাচারী মনে হলেও এটা করতেই হবে।”
‘নিরাপত্তহীনতা থেকেই’ অস্বাভাবিক চাহিদা: আকাশ
বাজারে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহ অনেক আছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার আশ্বস্ত করা হলেও ভোক্তারা ‘নিরাপত্তাহীনতা থেকেই’ বেশি বেশি পণ্য কেনায় বাজারে চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক এম এম আকাশ।
“নিরাপত্তহীনতা থেকে এই চাহিদা তৈরি হয়। আর এটা তৈরি হয়েছে অতীতে তারা দেখেছে দাম বাড়লে দীর্ঘদিন তা অব্যাহত থাকে। এ রকম অভিজ্ঞতার কারণে আরও দাম বাড়ার ভয়ে সবাই বেশি বেশি কিনে রাখে। সবাই মিলে যখন কিনতে যায় দাম আরও বাড়ে। অস্বাভাবিক চাহিদা বাড়লে দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।”
এর সমাধান কী, সেই প্রশ্নে অধ্যাপক আকাশ বলেন, “সমাধানের উপায় হল মানুষকে আশ্বস্ত করা। পণ্যের প্রচুর মজুদ আছে, সরবররাহ আছে, সহসা বাজার থেকে পণ্য উধাও হবে না- এসব বিষয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারলে এমন পরিস্থিতি থাকবে না। এজন্য সরকারের উচিত তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরে সাপ্লাই ইনফরমেশন দেওয়া।”
সরকার পণ্যের মজুদ নিয়ে কথা বললেও তা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না মন্তব্য করে অধ্যাপক আকাশ বলেন, “সরকারকে দেখাতে হবে কোথায় কত মজুদ আছে। মজুদ যেখানে আছে প্রয়োজনে সেখানকার ছবি তুলে দেখাতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে হবে।”
“বেশি কিনলে জিনিসপত্রের ঘাটতি হবেই, তখন দাম বাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সাপ্লাইয়ের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে আসতে হবে, যেখানে নির্ধারিত দামে জিনিসপত্র বিক্রি হবে। এটা সরকার করছে তবে অনেক বেশি করতে পারলে এই অস্বাভাবিক চাহিদা থাকত না। তখন বাজারেও এর প্রভাব পড়ত।”
দুর্যোগ বা সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে সরকার গাইডলাইন দিতে পারে বলে পরামর্শ রেখে অধ্যাপক আকাশ বলেন, তবে সেটা ভোক্তাদের কাছে উল্টো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি না, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।
এখনই দাম বেঁধে দিন: নাজনীন
চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, লবণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর কোনটা সর্বোচ্চ কত দামে বিক্রি করা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ।
চাহিদা ও যোগান সমান না হলে বাজারে প্রভাব পড়ে জানিয়ে তিনি বলছেন, চাহিদা বেড়ে গেলে দাম বাড়ে, কিন্তু মানুষ যদি মনে করে পরের দিন দাম আরও বাড়বে তখন আরও কেনে, তখন দ্বিতীয় দফায় দাম বাড়ে। এই সুযোগে বিক্রেতারা দাম বাড়ায়।
“দুর্যোগে দ্রুত সাড়া দেওয়াটা সরকারের পক্ষে অসুবিধা হয়। ওই সময় দরকার হল নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানো, যাতে তাদের অসুবিধা না হয়। এই মুহূর্তে গরিব মানুষদের খাওয়াতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী সবার এটা করা উচিত বলে আমি মনে করি।
“এই মুহূর্তে কিছু নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার।”
নাজনীন বলেন, “খাদ্যের হয়ত অভাব হবে না, তবে অন্য জিনিসগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে, যেটা নেতিবাচক। অর্থনীতি বড় একটা ধাক্কা খাবে, সেটার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আর সেই ধাক্কার মধ্যে আমি-আপনি সবাই পড়ব।
“অনেক জায়গায় ছাঁটাই হবে, বেতন কম হবে…। পুরো বিষয়টি নিয়েই ভেবে রাখতে হবে।”
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অনেক কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ পাচ্ছেন না অনেকে।
সে কথা তুলে ধরে নাজনীন বলেন, “তাদের জন্য অল্প পয়সায় বা বিনা পয়সার খাদ্য বিতরণের কর্মসূচি নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে।”