দেশের প্রবৃদ্ধি ‘সুতা কাটা ঘুড়ির মত’: সিপিডি

দেশের অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক দেখছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2019, 01:47 PM
Updated : 3 Nov 2019, 01:47 PM

রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা:  ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রারম্ভিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দেশের প্রবৃদ্ধিকে ‘সুতা কাটা ঘুড়ি’ উল্লেখ করে বলেন, “কাটা সুতার সাথে যেমন ঘুড়ির সম্পর্ক থাকে না, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “রপ্তানি বাড়াতে সরকার সংস্কারের দিকে না গিয়ে বরং প্রণোদনার দিকে গিয়ে ভুল করছে। প্রণোদনার মাধ্যমে কর ফাঁকি ও বিদেশে টাকা পাচারের আসক্তি তৈরি করা হচ্ছে।”

সরকারের নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাগাদা দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা থাকলে দেশের অর্থনীতি টেকসই হবে না।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত সিপিডির প্রতিবেদন কোনো নেতিবাচক প্রচারের জন্য নয় উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, “বাজেট বাস্তবায়নের জন্য কিছু উপাদান সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই এই প্রতিবেদনে বিষয়গুলো তুলে এনেছি।”

সিপিডি প্রস্তাবিত সুপারিশ আমলে নিয়ে সরকার তাদের নীতি পর্যালোচনা করবে বলেও মনে করেন তিনি।

“বর্তমানে তথ্য-উপাত্তের লভ্যতা কমে এসেছে। তাই মুক্ত বিচার বিশ্লেষনের জায়গাটা সংকুচিত হচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত সুষ্ঠু বা নির্ভরযোগ্য না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার নিজেই।”

তথ্য-উপাত্তের লভ্যতা না থাকলে অর্থনীতির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব সৃষ্টি হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। 

”এই স্বচ্ছতার অভাব সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে নীতি নির্ধারকদের। কারণ উনারা যে সিদ্ধান্তগুলো নেন সেগুলো যদি সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে না হয় তাহলে সিদ্ধান্তের ভ্রান্তি হওয়ার আশংকা দেখা দেয়।”

পুঁজিবাজারকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বর্ণনা করে বিভিন্ন সময় এর অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয় সিপিডির প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদন থেকে সামষ্টিক অর্থনীতির আরেকটি অঙ্গ পুঁজিবাজারের সংস্কার প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করেন গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, “গত নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। সম্প্রতি গ্রামীণফোন ও বিটিআরসির মধ্যে টানাপড়েন সম্পর্কও বাজারে প্রভাব ফেলেছে। নানা প্রতিশ্রুতিও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারছে না।”

সিপিডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ কারণে পুঁজিবাজারে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

এগুলো হচ্ছে- দুর্বল আইপিও, বিশৃংখল আর্থিক বিবরণী, বিও অ্যাকাউন্টে স্বচ্ছতার অভাব, সেকেন্ডারি মার্কেটে সন্দেহজনক লেনদেন এবং প্রশ্নবিদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “যে কোম্পানি তিন বছর ধরে বার্ষিক সাধারণ সভা করে না, সে কোম্পানি হঠাৎ করে সেরা লাভজনক কোম্পানি হয়ে উঠে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এই ঘটনা তদন্ত করে না। করলেও যথেষ্ট না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কারণেও অনেক সময় বাজার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।”

নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি আরও বেশি শেয়ার ও বন্ড মার্কেটের শেয়ার যোগানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সিপিডির প্রতিবেদনে।

সামষ্টিক অর্থনীতির রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, পুঁজিবাজার এবং বৈদেশিক লেনদেন খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করে তোলার পরামর্শও এসেছে সিপিডির কাছ থেকে।

মূল প্রবন্ধে জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “বর্তমানে দেশের প্রধানত চারটি খাতে স্থবিরতা ও নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

“যেমন রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়তে পারছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজস্ব আহরণ জাতিসংঘের হিসাবে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তা ১৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির টার্গেট করেও লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না।”

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ।অর্থাৎ চলতি অর্থবছরেও ব্যাপক ঘাটতির দিকে যাচ্ছে।

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “বিবিএস পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় হিসাবে দেখা গেছে দেশের ৭০ লাখ মানুষ কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বর্তমানে ৩৮ লাখ টিআইএনধারী থাকলেও তার মাত্র ৫৮ ভাগ কর দিচ্ছে।”

এই ঘাটতি পূরণে উপজেলা পর্যন্ত রাজস্ব বোর্ডের শাখা বাড়িয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

”বিশেষ করে শুল্কছাড় কমাতে হবে, কর অব্যাহতির লাগাম টেনে ধরার সময় এসেছে”, বলেন তৌফিকুল ইসলাম খান।

ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করছে সিপিডি। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চলতি অর্থবছর থেকে কর আহরণ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে কর ফাঁকির প্রবণতা কমাতে হবে বলে পরামর্শ সিপিডির।

ব্যাংকিং সেক্টরকে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থবির অবস্থায় থাকা দ্বিতীয় খাত উল্লেখ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক  ফাহমিদা খাতুন বলেন, “খাতটিতে সম্প্রতি তারল্য বাড়লেও ব্যক্তিখাতে ঋণ কমেছে।

“সরকারের পক্ষ থেকে যে ৯ এবং ৬ শতাংশ সুদ হার নির্ধারণ করা হয় তাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমানে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বলা হলেও তা আসলে দুই লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা বলে আইএমএফ প্রতিবেদনে এসেছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন ফাহমিদা খাতুন।

সিপিডির মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ঋণের সুদ হার নির্দিষ্ট করে দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো যায় না। আর বিনিয়োগ সুদের হারের ওপর নির্ভরও করে না।

বিনিয়োগের সুদের হার বাজার রেটের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফাহমিদা বলেন, “বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগ বিষয়ক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন।”

খাতটিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। 

বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে নীতিমালা পালনে বাধ্য করতে হবে বলে পরামর্শ সিপিডির। 

সিপিডির প্রতিবেদনের শেষাংশের বৈদেশিক লেনদেন প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বৈদেশিক লেনদেন খাতেও কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আমাদের এক সময়ের ১০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ এখন প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার হলেও এটি এখন মাত্র পাঁচ মাসের আমদানির ভার বহন করতে পারে।

“এক সময় এটা আট মাসের ছিল। সম্প্রতি যুক্তিসঙ্গত কারণেই আমাদের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি পাঁচ মাসের হয়েছে।”

রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমানো, দেশে কাঁচামাল উৎপাদনের সুবিধা বাড়ানো এবং টাকার অবমুল্যায়ন আরও বাস্তবসম্মত করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।