নতুন বাজেটে ‘নতুন কিছু নেই’

ভোটের বছরে সবাইকে তুষ্ট রাখার লক্ষ্য নিয়ে ব্যয়ের পরিমাণ ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘোষণা করেছেন, সেখানে নতুনত্ব তেমন কিছু দেখছেন না অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। 

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2018, 04:27 PM
Updated : 7 June 2018, 04:48 PM

তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া বিগত বাজেটগুলোর ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে মুহিতের দেওয়া ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার এই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। বাকিটা সরকার যোগাবে ঋণ করে। 

রাজস্ব আদায়ের ‘অসম্ভব’ লক্ষ্য

বাজেটের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সব মিলিয়ে বাজেটে নতুনত্ব কিছু নেই।একটা পজিটিভ দিক যেটি আছে সেটা হল দরিদ্র মানুষের জন্য বিভিন্ন ভাতা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এটা ভালো দিক।”

আহসান এইচ মনসুর

মুহিত তার বাজেটে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য ভাতা ও বরাদ্দ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেছেন।

হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের সহায়তার জন্যও বরাদ্দ বেড়েছে মুহিতের বাজেটে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে অনেক সমস্যার কথা তিনি বলেছেন। যদি তিনি এটা করতে পারেন তাহলে খুবই ভালো কাজ হবে বলে আমি মনে করি।”

তবে বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য মুহিত ঠিক করেছেন, তা অর্জন করা ‘একেবারেই সম্ভব নয়’ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, “বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে বড় টার্গেট ধরা হয়েছে রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক সস্কার ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।”

মুহিত তার বাজেটের ৭৩ শতাংশ অর্থ রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা আয়কর, ভ্যাট ও অন্যান্য কর হিসেবে আদায় করার দায়িত্ব পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেও তা সম্ভব না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টানায় নামিয়ে আনা হয়।

বাজেট দেওয়ার আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, নির্বাচনের আগে এবার নতুন কোনো কর আরোপ করা হচ্ছে না। সেই কথা তিনি রেখেছেন।

করের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ায় বাজেট ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হবে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বাজেট ব্যবস্থাপনায় হয়তো সমস্যা হবে না। তবে বাস্তবায়নে সমস্যা হবে। টাকা না এলে বাস্তবায়ন হবে কি করে?”

‘সম্প্রসারিত রূপ’

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দশম বাজেটে এসে তেমন কোনো নতুনত্ব দেখছেন না অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখতও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার বিবেচনায় সংসদে যে বাজেট দিয়েছেন, সেটি তার আগের দেয়া বাজেটগুলোরই ধারাবাহিক সম্প্রসারণমূলক বাজেট।”

অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত

করপোরেট ট্যাক্স কমানোর ঘোষণাকে এই বাজেটের ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন জায়েদ বখত। তিনি বলছেন, এর ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে; ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আরোপিত কর বিদ্যমান ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আর অতালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আরোপিত কর বিদ্যমান ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে।

জায়েদ বখতের ভাষায়, রাজস্ব আদায়ের যে বড় টার্গেট বাজেটে নেওয়া হয়েছে তা অর্জন করা ‘কঠিন’। তবে বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ১৮ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধিকে তিনি ‘সন্তোষজনই’ বলেছেন।

“এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে এবং নতুন করদাতাদের যদি করজালের আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে লক্ষ্য পূরণ না হলেও ভালো প্রবৃদ্ধি হবে বলে আমি আশা করি।”

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এই গবেষক বলেন, “বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের এই বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, কোন বাজেটই কিন্তু পুরোটা বাস্তবায়ন হয় না বা পুরো রাজস্ব আদায় হয় না। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুণগত মান, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, অনিয়ম বা দুর্নীতি হচ্ছে কিনা-সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।”

প্রস্তাবিত বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট বলা হচ্ছে- এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জায়েদ বখত বলেন, “আমি বিষয়টি ওভাবে দেখি না। প্রত্যেক সরকারের প্রত্যেক বাজেটেরই একটা রাজনৈতিক দর্শন থাকে। সেই দর্শনকে সামনে রেখে বাজেট দিতে গিয়ে যদি সাধারণ মানুষের উপকার হয় সেটাকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখা উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

সংস্কারের উদ্যোগ কই?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা এবারের বাজেটে সরকারের নীতিগত কোনো পরিবর্তন দেখছেন না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরে বাজেট বৃদ্ধির যে ধারাবাহিকতা সেটা এতে প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, নির্বাচনী বছরের নতুন করে কর আরোপ করবেন না। সেটা বাজেটে লক্ষ্যণীয়।”

সায়মা হক বিদিশা

তবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য অর্থমন্ত্রী নিয়েছেন, সেটা তুলে আনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ হবে বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।

“লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআরের সক্ষমতা অল্প সময়ে কী করে বাড়বে সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট কিছু দেখছি না। করের জাল বাড়াতে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেটারও কোনো নির্দেশনা নেই।”

দীর্ঘমেয়াদে সরকারের লক্ষ্য অর্জনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কিংবা কর সংক্রান্ত আইন সংস্কারের কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপও বাজেটে অনুপস্থিত বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই শিক্ষক।

বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধির পরামর্শ

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও বাজেটে বড় ধরনের কোনো চমক বা পরিবর্তনের আভাস দেখছেন না। বরং তিনি কিছু ‘অসঙ্গতি’ খুঁজে পাওয়ার কথা বলেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশ বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম এই বড় আকারের বাজেট কী করে বাস্তবায়ন হবে তার একটি দিক নির্দেশনা, শক্ত কথা বা কর্মসূচির উল্লেখ থাকবে, যা আমরা পাইনি।”

সেলিম রায়হান

সেলিম রায়হানের মতে, এ বাজেটে কর আদায়ের প্রক্ষেপণ বাস্তবসম্মত হয়নি। এর ফলে বছরের শেষে এসে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা কাটছাঁট করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

“কর আদায়ের ক্ষেত্রে এখনও বড় একটা লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যদিও এবছর নতুন কোনো করের কথা বলা হয়নি বরং কিছু-কিছু কর ছাড়ের কথা বলা হয়েছে; কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব আছে, তাহলে কীভাবে এত বড় কর আদায় করা হবে?

তার ধারণা, ভোটের বছর বলে বছরের শেষ দিকে অতিরিক্ত খরচের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। তাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কক্ষচ্যুত হতে পারে।  

“যদি আমরা প্রকল্প যাচাই-বাছাই না করে নির্বাচনকেন্দ্রিক খরচ বাড়িয়ে দিই, নতুন সরকারের জন্য তা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।”

সেই সম্ভাবনা এড়াতে প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের নজরদারি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অযথা অপচয় না করে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।