দেশে সিগারেটের দাম বাড়িয়ে রপ্তানিতে উৎসাহ

দেশে তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে দাম বাড়ানোর পাশাপাশি লাভজনক এই খাত থেকে আরও লাভ করতে তামাক রপ্তানি উৎসাহিত করার পরিকল্পনা বাজেট প্রস্তাবে হাজির করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2018, 12:44 PM
Updated : 7 June 2018, 04:55 PM

এর অংশ হিসেবে প্রক্রিয়াজাত তামাক রপ্তানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন মুহিত।

সেখানে ফিল্টারযুক্ত বিড়ির ক্ষেত্রে ২০ শলাকার প্যাকেটের মূল্য ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

নিম্নতম মূল্য স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার দাম ২৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২ টাকা বা তার বেশি এবং সম্পূরক শুল্ক ৫২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

মধ্যম স্তরে দশ শলাকার সিগারেটের মূল্য ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে হবে ৪৮ টাকা; সম্পূরক শুল্ক ৬৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশ হবে।

উচ্চস্তরের দশ শলাকার সিগারেটের দাম ৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা এবং ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। উচ্চস্তরের ১০ শলাকার যে সিগারেটের দাম এখন ১০১ টাকা, তার দাম ও ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত থাকবে।

মুহিত বলেন, আগামী দিনের লক্ষ্যমাত্রা হবে নিম্নতম স্তর ৭৫ টাকায় উন্নীত করা যেখানে সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ শতাংশ। অন্য সিগারেটের জন্য তখন একটি একটি সুপিরিয়র স্তর থাকবে, যেখানে সম্পূরক শুল্ক হবে আরও বেশি।

এই পরিকল্পনার ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী বলেন, “তামাক একটি কৃষিপণ্য হলেও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিধায় তামাকের উৎপাদনকে সরকার সবসময় নিরুৎসাহিত করে আসছে। তাই তামাক জাতীয় সকল পণ্যের আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয়ে উচ্চহারে শুল্ক-কর আরোপিত আছে।

কিন্তু শুরু থেকেই সিগারেট শিল্প একটি ‘উত্তম লাভের’ খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মন্তব্য করে মুহিত বলেন, “তামাক প্রক্রিয়াজাতপূর্বক রপ্তানি উৎসাহিত করতে তামাকজাত পণ্যের উপর আরোপিত ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছি।”

অর্থমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ থেকে তামাক নির্মূলের কথা বলে আসছেন। ‘সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে’ ২০৩০ সালের মধ্যে বিড়ি উৎপাদন এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সিগারেটের উৎপাদন ‘নি:শেষ করার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাকবিরোধী কনভেনশনের কারণে তামাক শিল্পের ‘মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে’ বলে মনে করলেও বাংলাদেশে তা ঘটতে আরও অন্তত ২০ বছর লাগবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।   

“তাই আমার মনে হয় তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগের সঙ্গে দেশীয় উচ্চমানের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম একসঙ্গে চলতে পারে।”

সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনটি ‘কাজ ও কৌশলের’ কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।এগুলো হল- ১. নিম্নমানের সিগারেট উৎপাদন দ্রুত বন্ধ করা; ২. মূল্যসীমা নির্বিশেষে এক করহার নির্ধারণ এবং ৩. একটি উন্নত দেশীয় ব্র্যান্ড অন্তত বিশ বছরের জন্য প্রতিষ্ঠা করা। 

বিড়ির ভয়াবহতা সিগারেটের চেয়ে বেশি মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “বর্তমান আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ফলে বিড়ির ব্যবহারকারী কমে যাচ্ছে। বর্তমানে এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যাও পূর্বের তুলনায় কম।”

অন্যদিকে জর্দা ও গুল স্বাস্থ্যের জন্য বিড়ি-সিগারেটের মতই ভয়াবহ মন্তব্য করে মুহিত বলেন, “তাই জর্দা ও গুলের ওজনভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করার সুপারিশ করছি। এক্ষেত্রে প্রতি দশ গ্রাম জর্দা ও গুলের ন্যূনতম মূল্য  নির্ধারণ করার প্রস্তাব করছি ২৫ টাকা। যেখানে সম্পূরক শুল্ক হবে ৬৫ শতাংশ।”

সন্তুষ্ট নয় তামাকবিরোধীরা

অর্থমন্ত্রী মুহিত তামাক নিয়ন্ত্রণের যে পরিকল্পনা নতুন অর্থবছরের বাজেটে উপস্থাপন করেছেন, তা ‘যথেষ্ট’ বলে মনে করছে না তামাক বিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা এবং এন্টি টোবাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা।

এক যৌথ বিবৃতিতে সংগঠন দুটি বলছে, সরকার উচ্চস্তরের (দশ শলাকা ১০১ টাকা) সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক গত তিন বছর ধরে অপরিবর্তিত রাখার মাধ্যমে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে।

এই মূল্যস্তরের সিগারেট বাজারে বহুল প্রচলিত এবং সিগারেট রাজস্বের একটি বড় অংশ আসে এখান থেকে।

উচ্চস্তরের সিগারেটের আরেকটি অংশের ১০ শলাকার দাম ৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হলেও ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে পরোক্ষভাবে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোকে লাভবান হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে তামাকবিরোধী সংগঠন দুটি।

বাজেটে প্রক্রিয়াজাত তামাকপণ্য রপ্তানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সমালোচনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, এটি ‘অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং চরম জনস্বাস্থ্যবিরোধী’ একটি পদক্ষেপ।

“এর ফলে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ২০৪০ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার নির্দেশনা উপেক্ষিত হবে।”

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য তুলে ধরে বিবৃতি বলা হয়, ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে জাতীয় মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৪.৬৪ শতাংশ। অথচ এই একই সময়ে এই উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম না বাড়ায় এর প্রকৃত মূল্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারও বাড়তি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তাছাড়া সব ধরনের সিগারেটের ক্ষেত্রে একক কর কাঠামো ও সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি প্রচলনের কোনো নির্দেশনা এবারের বাজেটেও না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছে প্রজ্ঞা ও আত্মা। 

বিবৃতিতে বলা হয়, “বিড়ির ব্যবহার বন্ধে অর্থমন্ত্রী একাধিকবার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিলেও বিড়ি কারখানার মালিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে প্রস্তাবিত বাজেটে ফিল্টারবিহীন বিড়ির ২৫ শলাকার মূল্য ১২.৫ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যা প্রহসন।”

তবে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে জর্দা গুলের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করায় অর্থমন্ত্রীর প্রশংসা করেছে সংগঠন দুটি।