হোম
+
চীনা বহুজাতিক গ্রুপ আলিবাবার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়ালের বিনিয়োগকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ হিসেবে দেখছেন বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির।
Published : 27 Apr 2018, 01:42 AM
মোবাইল ও অনলাইন লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম আলিপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর উদযাপনের ক্ষণে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় একথা বলেন বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার র্যাডিসন হোটেলে এই উদযাপন অনুষ্ঠানের আগে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পথ প্রদর্শক বিকাশের কৌশলগত অংশীদার হতে চুক্তি হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফিনটেক (ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি) কোম্পানি অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়ালের, যারা আলিপে পরিচালনা করে।
বিকাশের মূল প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ব্যাংক জানিয়েছে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুই ধাপে বিকাশের মোট ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হতে পারে আলিপে।
কী পরিমাণ অর্থে এই লেনদেন হয়েছে, সেই বিষয়ে এই মুহূর্তে মুখ খুলতে রাজি নন কোনো কোম্পানির কর্মকর্তারা। তবে এই চুক্তির ‘জটিল’ আলোচনার সঙ্গে জড়িত নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছে, এই লেনদেনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিটির মূল্যায়ন করা হয়েছে ৬৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কামাল কাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই চুক্তিতে লাভবান হয়েছে উভয় পক্ষ, সেই সঙ্গে বাংলাদেশও।”
জাতিসংঘের মানদণ্ডে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি লাভের কয়েক মাসের মধ্যে বিকাশের হাত ধরে বাংলাদেশের বাজারে ঢুকল বিশ্বের ‘অনলাইন মার্কেটিং জায়ান্ট’ আলিবাবা।
অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলা হত, সেটা এখন আর সেখানে নাই। বাংলাদেশ এখন আলিপে’র মতো প্রতিষ্ঠানকে ধারণ করার মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।”
অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়ালের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে কামাল কাদির বলেন, “এই ধরনের বিনিয়োগের সত্যিকার অর্থে বড় প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর আস্থা যে বাড়ছে, তারই প্রকাশ এটা।”
তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত অগ্ররমানতার মধ্যে এল অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল।
“এই বিনিয়োগ অনেক সম্ভাবনার পথ খুলে দেবে বিকাশের জন্য। পাশাপাশি বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশের আসার ক্ষেত্রে আস্থা জোগাবে।”
বিকাশের অংশীদার হতে পেরে ‘খুশি’ অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়ালের নির্বাহী চেয়ারম্যান এরিক জিং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তথ্য প্রযুক্তি সেবা বিস্তৃত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে আর্থিক সেবার আওতায় আনতে কাজ করবেন তারা।
অনুষ্ঠানে অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়ালের নির্বাহী চেয়ারম্যান এরিক জিংয়ের সঙ্গে আলাপে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী; পাশে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির
অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়ালের বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি গ্রাহক রয়েছে । মোট ৪০টি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছে তাদের এই সেবা।
২০১১ সালে যাত্রা শুরুর পর প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবা পাওয়ার বাইরে থাকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীরা কাছে এখন অতিপরিচিত একটি নাম বিকাশ। মোবাইল ব্যাংকিং ও বিকাশ শব্দ দুটি সাধারণ মানুষের কাছে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই প্রতিষ্ঠানের সংযুক্তি উদযাপনের অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রী, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে ব্যবসায়ী নেতাসহ বিকাশের অংশীদাররাও উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন যখন বিকাশের সঙ্গে বিনিয়োগ করতে এসেছিল তখনও অভিভূত হয়েছিলেন জানিয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, “তখন মনে হয়েছিল, একটি ফাউন্ডেশন হয়ত বাংলাদেশের দিকে সুনজরে তাকাচ্ছে। কিন্তু আজকে আলিপে যখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসছে, তখন এটি কিন্তু সুনজরে তাকানো না, বাংলাদেশ সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে, আজকের এই আয়োজন।”
অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার
বিকাশের প্রশংসায় তিনি বলেন, “আর্থিক লেনদেনের কথা যদি আমরা বলি তাহলে তার নাম বিকাশ। ‘আমাকে বিকাশে কিছু টাকা পাঠায় দিও’ বলে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিকাশ এমন একটি জায়গা দখল করেছে যে জায়গাটি অন্য কারও পক্ষে দখল করা কঠিন।”
বিকাশের যে যাত্রা তার পথ ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিদিন তার রূপ বদলাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন তার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করছে।
“২০০৮ সালে বাংলাদেশ কোথায় যাবে সেটা আমরা ভাবতে পারিনি, সেই বাংলাদেশ এখন প্রতিটি সূচকে প্রথম সারিতে আছে।”
তথ্য প্রযুক্তি খাতে ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকা চীনের কোম্পানির সঙ্গে বিকাশের অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের আরও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী পলক।
অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক
আলিপের সহায়তায় ভারতে পে-এটিম কাজ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পার্শ্ববর্তী ভারতে দেখছি, কীভাবে তারা উবারকে ওলা দিয়ে কমপিট করছে, পেইপ্যালকে পে-এটিএম দিয়ে কমপিট করছে।”
অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ বলেন, “দ্রুত অর্থনৈতিক সেবা দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীসহ সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা বিকাশ চালু করেছি। সে লক্ষ্যে আমরা অনেক দূর এগোতে পেরেছি।”
অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ
তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে সংখ্যক মানুষকে আর্থিক সেবার যুক্ত করা গেছে, পৃথিবীর বহু দেশ এখনও তা করতে পারেনি।
“আমি আশা করি, বাংলাদেশের সব মানুষ কেবল মোবাইলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সেবা কেবল অর্থ লেনদেন সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ক্রেডিট এবং ইন্সুরেন্সের মতো ব্যাপারও এর মাধ্যমে করবে।”
বিকাশের শেয়ারের ৫১ শতাংশ ব্র্যাক ব্যাংকেরই থাকছে। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার মালিকদের মধ্যে মানি ইন মোশন (মিম), ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ও বিল অ্যান্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ছেড়ে দেওয়া শেয়ার থেকে পাবে আলিপে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা
চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জানানো হয়, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বিকাশের প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ারের মালিক। আর মিমের অংশ ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আইএফসির ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে মিম প্রাথমিকভাবে এর ৫ দশমিক ৯ শতাংশ শেয়ার ছাড়ছে আলিবাবার কাছে। আর আইএফসি ছাড়ছে দুই শতাংশ। আলিবাবার পাওয়া বাকি শেয়ারগুলো আসবে প্রেফারেন্সিয়াল শেয়ার থেকে।
ব্যাংকের প্রাইস সেনসিটিভ ইনফরমেশন (পিএসআই) সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পরই শেয়ার ছাড়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। পুরো কার্যক্রম শেষ হতে ১৫ থেকে ১৮ মাস লাগতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
অ্যান্ট ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী চেয়ারম্যান এরিক জিং বলেন, “বিকাশ মানুষের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছে, আমরা সেটাকে আরও এগিয়ে দিতে চাই।”
অনুষ্ঠানে অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়ালের নির্বাহী চেয়ারম্যান এরিক জিং
তিনি বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের ক্ষেত্রে আরও সহায়তা বিকাশকে দেবেন তারা। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন সহজতর করা এবং লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয় থাকবে।
“কিউআর কোডের মাধ্যমে সহজে বিকাশ ওয়ালেটের অর্থ লেনদেনের দিকেও নজর দেব।”
বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির বলেন, “আলিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে তারা যেসব প্রযুক্তি সারা পৃথিবীতে ব্যবহার করছে, তার বিনিময় হবে। এখন আমরা যে জায়গায় সেখান থেকে বহুদূর এগিয়ে যাব।”
অংশীদারিত্ব উদযাপনের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এটা কেবল আমাদের দুই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব নয়, এটা বাংলাদেশের প্রতি আস্থার স্বীকৃতিও। আলিপেকে পাওয়া আমাদের জন্য খুবই এক্সাইটিং।”
বিকাশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এমআইটির লেগাটাম সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অন্টারপ্রেনরশিপের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ইকবাল কাদির উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানে, যিনি গ্রামীণ ফোনের একেবারের প্রথম দিককার উদ্যোক্তাদের একজন।
এ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন গ্রামীণ ফোনের সাবেক চেয়ারম্যান ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি খালেদ শামস, ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপক বিস্তারে যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
অর্থ সচিব মুসলিম চৌধুরীও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিকাশের চেয়ারম্যান শামেরান আবেদ।
অনুষ্ঠানে বিকাশের চেয়ারম্যান শামেরান আবেদ
উদযাপনকে ঘিরে বর্ণিল করে সাজানো হয় হোটেল র্যাডিসনের বলরুমকে। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার পাশাপাশি নৈশভোজে শেষ হয় অনুষ্ঠানমালা।
