দুই বছরের পড়তি ভাব কাটিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, গত চার মাস ধরে টানা বাড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
Published : 01 Feb 2018, 09:48 PM
রেমিটেন্স বৃদ্ধির এই ধারাকে ইতিবাচক অভিহিত করে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং অবৈধ পথে প্রবাসীদের অর্থ লেনদেনকারী মোবাইল অ্যাকাউন্টধারীদের বিরুদ্ধে অভিযানের কারণে প্রবাসীরা বৈধ পথে (ব্যাংকিং চ্যানেল) টাকা পাঠাচ্ছেন। পাশাপাশি বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিও বেড়েছে।
সদ্য সমাপ্ত জানুয়ারি মাসে অর্থাৎ ২০১৮ সালের প্রথম মাসে ১৩৮ কোটি (১.৩৮ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অংক গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ বেশি এবং চলতি অর্থবছরের সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আগের মাস ডিসেম্বরের চেয়ে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
আর চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
রেমিটেন্স প্রবাহের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
চলতি অর্থবছরে রেমিটেন্স ১৪ বিলিয়ন (এক হাজার ৪০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আনতে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোরালো কার্যক্রম অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ (১৫.৩১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স বাংলাদেশে আসে। এরপর প্রতিবছরই রেমিটেন্স কমেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমে রেমিটেন্স আসে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা সাড়ে ১৪ শতাংশ কমে আসে ১ হাজার ২৭৭ কোটি ডলার, যা ছিল আগের ছয় অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
রেমিটেন্সের উৎস দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা এবং মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য মাধ্যমে হুন্ডি প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈধপথে প্রবাসীদের অর্থ কম আসছিল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে গেলে রেমিটেন্স কমে যায়। আগে হুন্ডিতে প্রচুর টাকা লেনদেন হত। এরই মধ্যে তিন হাজার অবৈধ মোবাইল একাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।”
রেমিটেন্স বাড়ার পিছনে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি। সে কারণে ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই রেমিটেন্স আনতে অতি বেশি উৎসাহী হয়েছে।
“বেশি টাকা পাওয়ায় প্রবাসীরাও বৈধ পথে টাকা পাঠাচ্ছেন। কার্ব মার্কেট এবং ব্যাংকে ডলারের দাম এখন সমান। সে কারণেই কোনো ঝুঁকি নেই ভেবে হুন্ডির মাধ্যমে না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলার (পণ্য আমদানির ঋণপত্র) পরিমাণ বেড়েছে। তাতে ব্যাংকগুলোর বেশি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে।
“সে কারণে ব্যাংকগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আনতে আগ্রহী হয়েছে।”
বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক বাংকগুলোর কাছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। আর ব্যাংকগুলো সেই ডলার ৮৪ টাকার বেশিতে বিক্রি করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক বৃহস্পতিবার ডলার বিক্রি করেছে ৮৪ টাকা ১০ পয়সায়। সোনালী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৮৪ টাকায়।
কার্ব মার্কেটেও (খোলা বাজারে) এই দরে ডলার বিক্রি হয়েছে বলে মতিঝিলের ডলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিপন জানিয়েছেন।
টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ডলার অবমূল্যায়িত ছিল। ভারত, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছিল। তার সুফল তারা পেয়েছে।
“আমরা অনেক দেরিতে সেই কাজটি করেছি। আমরাও তার সুফল পাচ্ছি। হুন্ডি কমছে। রেমিটেন্স বাড়ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ব্যাংকিং চ্যানেলে ৮৩১ কোটি ২১ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।
তবে এরমধ্যে কোরবানির ঈদের পর গত সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ৮৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। একক মাসের হিসেবে যা ছিল সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে। দ্বিতীয় মাস অগাস্টে আসে ১৪১ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। অক্টোবর মাসে এসেছে ১১৬ কোটি ২৭ লাখ ডলার। নভেম্বর মাসে আসে ১২১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। ডিসেম্বরে এসেছিল ১১৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয়েছে ১৩৮ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো এই বৈদেশিক মুদ্রা।
দেশের রেমিটেন্সের অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে।