জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমল

সোমবার মধ্যরাত থেকেই নতুন দর কার্যকর, বলেছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2022, 01:34 PM
Updated : 29 August 2022, 01:34 PM

জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৫০ শতাংশের মতো বাড়ানোর ২৩ দিন পর দাম কিছুটা কমিয়েছে সরকার।

ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোল এই চার ধরনের জ্বালানির দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানোর সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা সোমবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

এরপর রাতে প্রজ্ঞাপন জারি হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে। তাতে জানানো হয়, নতুন দর সোমবার মধ্যরাত থেকেই কার্যকর হবে।

মহামারীর পর ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি সঙ্কটকে কারণ দেখিয়ে গত ৬ অগাস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার।

তাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বেড়ে হয় প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার ১৩০ টাকা এবং প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৫১.৬৮ শতাংশ বেড়ে হয় ১৩৫ টাকা।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে পরিবহন ভাড়াসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, যা নিয়ে জনজীবনে ক্ষোভ রয়েছে।

এখন ৫ টাকা কমানোয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম হবে প্রতি লিটার ১০৯ টাকা, পেট্রোলের দাম হবে ১২৫ টাকা এবং অকটেনের দাম হবে ১৩০ টাকা।

Also Read: ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক ধাক্কায় ৪২.৫%; অকটেন ও পেট্রোলে ৫১% বাড়ল

Also Read: শুল্ক কমার প্রভাব বুঝে তেলের দাম সমন্বয়

মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমানোর ইঙ্গিতও দেওয়া হয়।

“কিছুটা কর কমানোয় জ্বালানি তেলের মূল্যে সমন্বয় করা হল। বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে আবারও সমন্বয় করা হবে।”

যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব বাজারে জ্বালানির দামের অস্থিরতার মধ্যে জুলাই মাসের শেষের দিক থেকেই ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ভাবনার কথা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মুখে শোনা যাচ্ছিল।

বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের আলোচনায় ‘প্রয়োজনে দাম বাড়িয়ে হলেও’ নিরাবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি উঠেছিল কয়েকজন ব্যবসায়ীর কণ্ঠে।

তবে সরকার যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল, তখন বিশ্ব বাজারে দাম কমতে থাকায় প্রশ্ন তৈরি হয়।

এর মধ্যেই রোববার ডিজেল আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর পাশাপাশি সব ধরনের অগ্রিম কর তুলে নেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, ডিজেলে সব মিলে প্রায় ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে আমদানি শুল্ক ২২ দশমিক ৭৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

এর আগে ডিজেল আমদানিতে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক, অগ্রিম কর ও অন্যান্য করসহ মোট ৩৪ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হত।

এরপর সোমবারই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, শুল্ক ও কর ছাড়ের প্রভাব কতটা পড়ছে, তা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে তারা জানতে পারবেন।

প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও সচিবালয়ে দুপুরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “কালকে কিছুটা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেই সুবিধার কারণে আমরা হয়ত চিন্তা করছি যে তেলের মূল্য কিছুটা সমন্বয় করতে পারব।

“হয়ত আজ-কালকের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নেব,” বলেন তিনি। এরপর সন্ধ্যায় দাম কমানোর ঘোষণা আসে প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে।

নতুন মূল্য সমন্বয়ের পর ডিজেল বিক্রিতে বিপিসির লোকসানের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্লাটস- এর হিসাবে, গত ২৬ অগাস্ট প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেলের মূল্য ছিল ১৪৭ দশমিক ৬২ মার্কিন ডলার। সে অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য পড়ে ১২৮ দশমিক ৬১ টাকা। অর্থাৎ ১০৯ টাকা ধরে ডিজেল বিক্রয় করলে প্রতি লিটারে বিপিসির লোকসান হবে ১৯ দশমিক ৬১ টাকা।

বিপিসি গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

প্রায় শতভাগ জ্বালানি তেল আমদানি করা বাংলাদেশের পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ তেলনির্ভর। দেশে ব্যবহৃত তেলের ৭০ শতাংশের বেশি ডিজেল।

মূল্য সমন্বয়ের পরও ভর্তুকি চালিয়ে যেতে হবে বলে সোমবারই সাংবাদিকদের বলেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি বলেন, “তেলের বাজার আবার বেড়ে গেছে। (প্রতি ব্যারেল) ১৫০ ডলারের ঊর্ধ্বে চলে গেছে, যেটা ১৩০ ছিল কিছুদিন আগে। এ অবস্থায় আমরা কতটুকু মূল্য সমন্বয় করতে পারব! কারণ এখানে ভর্তুকির একটা বড় অংশ যোগ হবে আবার।

“যখন ডিজেল ১১৪ ডলার ছিল তখন ৮ টাকার ওপরে লোকসান হয়েছে। এখন হয়ত সেই জায়গাটা আরও বাড়বে।”

Also Read: বিপিসির লাভের গুড় খাচ্ছে ইউক্রেইন যুদ্ধ

তবে আন্তর্জাতিক বাজারে আবার দাম বেড়ে যাওয়ায় নিজের আশঙ্কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তেলের দাম আবারও বেড়ে গেছে। এটা আমরা আশাই করি নাই। আমরা মনে করেছিলাম, ট্রেন্ডটা নিচের দিকে যাবে। এখন এটাও ভয় পাচ্ছি, আরও বেড়ে যায় নাকি।”

গত ৬ অগাস্ট বাড়ানোর আগে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। তখন প্রতি লিটারে দাম ৬৫ টাকা থেকে ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা। নয় মাসের মাথায় তা এক লাফে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকায় নেওয়া হয়। সেখান কমানো হল ৫ টাকা।

অকটেন আর পেট্রোলের দাম সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল। সেই হিসাবে ছয় বছর ২ মাস পর বাড়ানো হয় এই দুই তেলের দাম।

৮৬ টাকার পেট্রোল ৪৪ টাকা বেড়ে ১৩০ টাকা এবং ৮৯ টাকার অকটেন ৪৬ টাকা বেড়ে হয় ১৩৫ টাকা। একবারে ৫০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির ঘটনা আর কখনও ঘটেনি।

গত ৫ জুন থেকে গ্যাসের দাম এক দফায় ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তখন খুচরায়ও দাম বেড়েছিল।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে গত মে মাসে, যার ওপর সিদ্ধান্ত আসার কথা রয়েছে।

ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে অস্থির বিশ্ব বাজারে এলএনজির দাম প্রতি ইউনিট ৭/৮ ডলার থেকে বেড়ে ৪০ ডলারে পৌঁছেছিল। অপরিশোধিত তেলের দামও প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলার থেকে বেড়ে ১৪৭ ডলার হয়েছিল।

সাত অর্থবছর মুনাফায় থাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ইউক্রেইন যুদ্ধে বড় ধাক্কা খেয়েছে; দীর্ঘদিন পর আবার লোকসানে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। অগাস্টের শুরুতে দাম বাড়ানোর আগে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার ওপর সংস্থাটি লোকসান দিচ্ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে।