বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা পুরুষের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা, নারীদের ৪ লাখ টাকা।
Published : 29 May 2024, 09:10 PM
দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে আসন্ন বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৬ লাখ টাকা করার দাবি উঠেছে।
বুধবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলন’ নামে একটি নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে এ দাবি উঠে আসে।
অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের একাংশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা অক্সফাম।
আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উঠবে। এরই মধ্যেই এডিপি, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাসহ বাজেটের বিভিন্ন বিষয়ের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাসহ সামাজিক নানা বৈষম্যের শিকার নিম্ন আয়ের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চেয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের একাংশ বলছে, অতি দরিদ্রদের জন্য বছরে কমপক্ষে ১০০ দিনের কাজের সুযোগ রেখে নতুন বাজেট করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “যারা অর্থনৈতিক নানা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নন, তারাই সব পাচ্ছেন। সত্যিকারেই যাদের পাওয়া উচিত, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা আসলেই কি দরিদ্র মানুষের কথা ভাবছি? এসব বিষয় বাজেটে কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, তা দেখার বিষয়।”
করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৬ লাখ টাকা করার সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, তাতে নিম্ন আয়ের মানুষ এর সুবিধা নিতে পারবে।
“সরকার বলে, রাজস্ব আয় বাড়ছে না। অথচ রাজস্ব আদায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কর ফাঁকি দেওয়ার কারণে। যারা কোটি টাকা আয় করেন, তারা করের বাইরে থেকে যান। কর ফাঁকি রোধ করা ও অতি ধনীদের করের আওতায় আনা দরকার।”
সমাজে ব্যাপকভাবে বৈষম্য বাড়ছে মন্তব্য করে সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, “কিছু মানুষের এত আয় হচ্ছে, কীভাবে তা খরচ করবে খুঁজে পায় না। বিদেশি শিল্পী ও খেলোয়াড়দের দেশে আনা হয়, ডলারে তাদের পেমেন্ট করতে হয়। এগুলো তো বিশাল অংকের। এতে সরকারের চেয়ে বেশি জড়িত করপোরেটরা, নিজেদের স্বার্থেই এসব করে তারা।”
আয় বৈষম্য কমানোর উপায় কী? মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষায়- দেশে প্রচুর পরিমাণে বিপুল সম্পদের মালিক রয়েছেন। তাই এখন ‘অ্যাসেট ট্যাক্স’ বা ‘সম্পদ কর’ এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দরকার। সরকার যদি আয় বৈষম্য কমাতে চায়, তাহলে অনেক বেশি সম্পদের মালিকদের সম্পদে কর ধার্য করে তা থেকে গরিবের অংশ নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, “গত দুই-তিন বছর ধরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। এখন অনেকে হিমশিম খাচ্ছে। কেউ ইংল্যান্ডে বেড়াতে যেতে পারছে না, কেউ বাচ্চাটাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছে না। এটাই হচ্ছে সমাজে মূল সমস্যা। বিষয়গুলো নতুন বাজেটে অ্যাড্রেস করা হয় কিনা, সেটা হচ্ছে বিষয়।”
জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘তাজমহল’ করা যায় না, কারণ আমাদের অর্থনীতি সেভাবে স্ট্রং হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা কিছু তাজমহল করে ফেলেছি; যেগুলো রিটার্ন দেয় না। তার মধ্যে একটা বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ।
“প্রায় লক্ষ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ যদি বাংলাদেশকে না দিতে হত, তাহলে আর্থিক সব সমস্যার সমাধান এ ক্যাপাসিটি চার্জের টাকা দিয়েই হয়ে যেত। লক্ষ কোটি টাকার দায় রাষ্ট্রের ওপর আসছে কিন্তু এই যুক্তিগুলো সংসদে আলোচনা হয় না।”
সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে পেনশন আইন বাস্তবায়ন, সার ও কৃষি উপকরণে ভর্তুকির দেওয়ার দাবি জানিয়ে ডিবিএমের এম শহিদুল্লাহ বলেন, করমুক্ত আয়সীমা ন্যূনতম ৬ লাখ টাকায় উন্নীত করা প্রয়োজন।
বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা পুরুষের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা, নারীদের ৪ লাখ টাকা। এর থেকে ওপরের আয়ের দিকে উঠতে থাকলে তাদের করের হারও বেশি হয়।
নারীদের আয়ে করমুক্ত সীমা ৭ লাখ টাকায় উন্নীত করার দাবি জানিয়ে অ্যাকশন এইডের প্রতিনিধি মৌসুমি বিশ্বাস বলেন, নারীদের ঋণ প্রাপ্তিতে ঋণ সহজ করার কথা বলা হলেও ব্যাংক বা কোনো সংস্থা তাদের ঋণ দিতেই চায় না। তারপর তার স্বামী বা পিতার আয়ের উৎস জানতে চায়। নারী যদি বলে সে নিজে ব্যবসা করবে, তাহলে তার ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়।
গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার মোস্তফা বলেন, এবারের বাজেট মূল্যস্ফীতির কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সরকারকেও এটা বিপদে ফেলে দিয়েছে। ডলারের দাম বেড়েছে, তাই সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে।
তৃণমূল থেকে যা শোনা গেল
উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠনের দাবি জানিয়ে বাগেরহাট গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের কর্মী নূর আলম শেখ বলেন, “আমাদের চারদিকে পানিতে থৈ থৈ করে অথচ খাবার পানি নাই। সবকিছু লোনা পানিতে ডুবন্ত।”
পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এলাকার বাসিন্দা কবির তালুকদার বলেন, “ঝড়ে আমার বাড়ি লন্ডভন্ড অবস্থায় আছে। তবুও আমি এই অনুষ্ঠানে আসছি শুধু কিছু কথা বলার জন্য। আমাদের যে সহযোগিতা সরকার দেয়, কিছু ভূমিদস্যুদের কারণে সেগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত। এসবে একটু নজর দিতে হবে। ভূমিহীনদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”
রিকশা ও ইজিবাক চালকদের পক্ষে শ্রমিক নেতা দাউদ আলী মামুন বলেন, এ সেক্টরের গাড়িগুলো উঠিয়ে দিতে চায় সরকার। ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি আমদানি করা হয় চীন থেকে।
“সরকারের কেউ না কেউ এগুলো আমদানি করে। তখন অবৈধ বলা হয় না। কিন্তু যখন আমরা কিনে গাড়িতে লাগিয়ে ব্যবহার করি, ঠিক তখনই ব্যাটারিকে অবৈধ বলা হয়। কয়েক লাখ মানুষ এ রিকশার ওপরে নির্ভর করে। তাই এটির ব্যাপারে সরকারকে সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করার দাবি জানাই।”
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী মাহমুদা মিতু বলেন, “আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, আমাদের ওষুধের একটা বড় লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ওষুধের বিকল্প অনেক ব্যবস্থা আছে, যা আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। আর দামি দামি যে লিস্ট ধরিয়ে দেয়, তা গরিব মানুষের জন্য একটা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই চিকিৎসা খাতে নজরদারি প্রয়োজন।”
আলোচকরা নতুন বাজেটে নিম্ন আয়ের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বেশ কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেন, যার মধ্যে রয়েছে- রেশনিং ব্যবস্থা চালু, দ্রুত পচে যায় এমন ফসলের জন্য হিমাগার প্রস্তুত করা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শ্রমিকদের জন্য বাজেট বাড়ানো, নারী শ্রমিকদের চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি, আধুনিক মেশিন ব্যবহারে গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, নারীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ, শ্রমজীবী নারীদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার, বাল্যবিবাহ রোধে সুস্পষ্ট নিরেদ্শনা।