২০২২ সালের খানা জরিপে ‘আয় বৈষম্যের’ জিনি সূচক পাওয়া গেছে ০.৪৯৯ পয়েন্ট, ছয় বছর আগে এটি ছিল ০.৪৮২ পয়েন্ট।
Published : 12 Apr 2023, 11:56 PM
দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, সেটির প্রমাণ মিলল পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের জরিপেই।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় ও ব্যয়, সবই কম। তবে শহরে আয় বৈষম্য বেশি, গ্রামের পরিস্থিতি তুলনামূলক কিছুটা হলেও ভালো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত গত ১২ বছরে তিনটি খানা জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য বেড়েই চলছে।
পরিবারের আয়, ব্যয়সহ সামগ্রিক বিষয়ের তথ্য জানতে চালানো সবশেষ খানা জরিপের যে তথ্য বিবিএস বুধবার প্রকাশ করেছে তাতে কোভিড মহামারী ও ইউক্রেইন যুদ্ধকালীন কঠিন সময়ে দারিদ্র কমার সুখবর দিলেও দেখা গেছে উন্নতির আড়ালে বৈষম্যও বাড়ছে।
খানা জরিপের সবশেষ পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, পরপর দুই দফায় বৈষম্যের হার বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও স্বীকার করেছেন বৈষম্য বাড়ছে।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় সম্পদে সবার সমান ভোগের অধিকার নেই বলেই এই বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।”
সরকারি ‘বৈষম্যমূলক’ আইন এ আয় বৈষম্যের কারণ বলেও মনে করেন তিনি।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ১৪ হাজার ৪০০ খানার তথ্য সংগ্রহ করে এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এ জরিপ অনুযায়ী বৈষম্যের জিনি সূচক পাওয়া গেছে ০.৪৯৯ পয়েন্ট। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে এটি ছিল ০.৪৮২ পয়েন্ট। তারও ছয় বছর আগে এটি ছিল ০.৪৫৮ পয়েন্ট।
অর্থাৎ সবশেষ ছয় বছরের ব্যবধানে (২০১৬ থেকে ২০২২) দেশে জিনি সহগ শুন্য দশমিক ০১৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে।
এ প্রতিবেদনে গত তিনটি খানা জরিপের তথ্য রয়েছে। তবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ বিনায়েক সেন জানান, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের সময়কার জরিপেও এভাবে আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছিল।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২২ সালে দেশে খানাপ্রতি মাসিক গড় আয় পাওয়া গেছে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। ছয় বছর আগে এটি ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে মানুষের আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
আবার খরচও বেড়েছে প্রায় একই হারে। ২০২২ সালে খানাপ্রতি মাসিক ব্যয় পাওয়া গেছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। ছয় বছর আগে তা ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।
বুধবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ‘খানা আয় ও ব্যয় ২০২২’ জরিপের এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামের চেয়ে শহরে বৈষম্য বেশি। আয় বৈষম্যের একক জিনি সহগ গ্রামে পাওয়া গেছে ০.৪৪৬ পয়েন্ট। এটি শহরাঞ্চলে ০.৫৩৯ পয়েন্ট।
অথচ শহরের তুলনায় গ্রামে খানাপ্রতি আয় কম। শহরে এবার খানাপ্রতি মাসিক গড় আয় পাওয়া গেছে ৪৫ হাজার ৭৫৭ টাকা। গ্রাম এলাকায় তা পাওয়া গেছে ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা।
জিনি সূচক কী
১৯১২ সালে ইতালির পরিসংখ্যানবিদ কোরাদো জিনি সূচকটি উদ্ভাবন করেন। এটি বিশ্বে আয়ের বৈষম্য পরিমাপ ও তুলনায় ব্যবহার করা হয়।
এটি অনুপাত বা ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা হয়, যেটির মান ০ থেকে ১ এর মধ্যে হবে। ভগ্নাংশটি হল বণ্টনের লোরেনৎস রেখা ও সুষম বিতরণ রেখার মধ্যবর্তী এলাকার ক্ষেত্রফল এবং সুষম বিতরণ রেখার নিচে অবস্থিত এলাকার ক্ষেত্রফলের অনুপাত। জিনি সহগকে ১০০ দিয়ে গুণ করে শতকরা হারে জিনি সূচক হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
জিনি সূচক অনুযায়ী, কখনও যদি সবার আয় সমান হয় তবে সূচক হবে শূন্য। এতে বোঝা যাবে ওই সমাজে বা ভৌগলিক এলাকা চরম সাম্য অবস্থায় রয়েছে। এর বিপরীতে সব আয় যদি একজনই করেন তাহলে সূচকটি হবে ১। এটি বৈষম্যের সর্বোচ্চ পর্যায়- চরম অসাম্য অবস্থা। সূচকের এ দুই সীমার মধ্যে সূচকের পরিমাণ বাড়লে বৈষম্যও তত বেশি বলে প্রকাশ পায়।
আন্তর্জাতিকভাবে আয় বৈষম্য নিয়ে কোনো নির্ধারিত মানদণ্ড না থাকলেও ইউনিসেফ বলছে, জিনি সূচক শূন্য দশমিক ২ এর কম হলে তা আয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ সমতা নির্দেশ করে; শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৪ হলে তা অপেক্ষাকৃত যৌক্তিক পার্থক্য এবং শূন্য দশমিক ৪ থেকে শূন্য দশমিক ৫ হলে বৈষম্য অনেক বেশি ধরা হয়ে থাকে।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল ০.৩৬। এরপর থেকে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।
কেন বাড়ছে বৈষম্য
বৈষম্য বাড়তে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান পুঁজির কারণে কিছু বৈষম্য হওয়ার কথা মেনে নিয়ে বলেন, “রাষ্ট্রের সম্পদে সবার সমান এক্সেস না থাকার কারণেও বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।”
তিনি বলেন, “বিলে, নদীতে, বনে, কাট কাঠা, মাছ ধরা, এখান থেকে তাদেরকে (সাধারণ মানুষকে) বের করে দেওয়া হচ্ছে।
“আমি মনে করি এগুলোর ওপর গরিব মানুষের হক আছে। কিন্তু নানা জায়গায় যেমন বালু মহাল, পানি মহাল, মাছ মহাল ইজারা দিয়ে আমরা এসব গরিব মানুষকে আমরা বঞ্চিত করছি। এগুলোকে আমি আইনগত বৈষম্য বলে আমি মনে করি।”
সরকার উন্নয়নের জন্য এসব ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন বলেন, “২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়েও বৈষম্য বেড়েছিল। আমরা একটি গবেষণা করে পেয়েছিলাম যে আত্ম-কর্মসংস্থান এবং চাকরির সুযোগ সৃষ্টির কারণে এটি বেড়েছিল।
তিনি বলেন, “যাদের কাছে অতিরিক্ত পুঁজি ও সম্পদ আছে তারা দ্রুত উঠে যাচ্ছে। আর যারা পারছে না তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। এই কারণে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।”
এবারের বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ কী, তা খুঁজে বের করতে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে কী হয়েছে তা বিশ্লেষণের পরামর্শ দেন তিনি।