তবু ৭.৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা

অর্থনীতিকদের অনেকে প্রবৃদ্ধির হারকে অর্থনীতির গতিশীলতা হিসেবে মানলেও টেকসই উন্নয়নের সূচক হিসেবে মানতে নারাজ। তারপরও অর্থনীতির এই প্রপঞ্চটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার আলোচনায় এসেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 10:02 AM
Updated : 1 June 2023, 10:02 AM

বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা আর নানামুখী চাপের মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও ভোটের বছরের জন্য আগের মতই বড় লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিনি।

অর্থনীতি চাপে থাকার পরও কেন এবার বেশি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন, সেই ব্যাখ্যা বাজেট বক্তৃতায় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “ধীরে হলেও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে, আমাদের বাণিজ্য ও প্রবাস আয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে মর্মে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এপ্রিল, ২০২৩ সময়ে প্রক্ষেপণ করেছে। একই সাথে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসার সুবাদে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে বলেও আইএমএফ এর প্রক্ষেপণে প্রকাশ পেয়েছে।

“বিশ্ব অর্থনীতির অনুকূল পরিবর্তন আমাদের জন্য আশার সঞ্চার করছে। একইসাথে, কোভিড পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ গতি সঞ্চার হয়েছে। এছাড়াও, অর্থবছরের শেষাংশে কৃষিখাতে ভাল ফলন আসছে। ১৯। সার্বিকভাবে, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কল্যাণে পূর্বের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসব ও ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব বলে আশা করছি।“

অর্থনীতিকদের অনেকে প্রবৃদ্ধির হারকে অর্থনীতির গতিশীলতা হিসেবে মানলেও টেকসই উন্নয়নের সূচক হিসেবে মানতে নারাজ। তারপরও অর্থনীতির এই প্রপঞ্চটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার আলোচনায় এসেছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর এল মহামারী। তার মধ্যেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্জিত হয় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।

মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে। দুঃসময় কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ।

মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা যখন ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করল তখনই শুরু হল ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে ফের টালমাটাল করে দেয়, আবার অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে অর্থনীতি।

বিশ্বের সব দেশকেই কমবেশি এর জের টানতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, চড়ে গেছে ডলারের বিনিময় হার। তাতে পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তায় এর বড় ধরনের প্রভাব থাকবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা দিয়েছিলেন, হয়েছেও তাই।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় তা সংশোধন করে নামিয়েছিল ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যাচ্ছে না। 

মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের হিসাব ধরে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে স্থির মূল্যে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হতে পারে।

অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্কলন বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে আরও কম, ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ডলারের হিসেবে দেশের জিডিপির আকার কমেছে ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

মুস্তফা কামাল অবশ্য আশা ছাড়ছেন না। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা ক্রমান্বয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি থেকে বের হয়ে এসে মেগাপ্রকল্পসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারক চলমান ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করব। এ উদ্দেশ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করে জিডিপির ৬.৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসাথে, বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ তৈরি, যেমন- নিষ্কণ্টক জমি, উন্নত অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন ইউটিলিটি, আর্থিক প্রণোদনা ও সহজ ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ইত্যাদি সুযোগ সুবিধাসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান অব্যাহত থাকবে।

“লজিস্টিকস খাতের উন্নয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কারের ফলে বিনিয়োগ/ব্যবসা প্রক্রিয়াকরণে সময়, ব্যয় ও জটিলতা হ্রাস পাবে। ফলে, চলতি বছরে কিছুটা হ্রাস পাওয়া বেসরকারি বিনিয়োগ আগামী বছরে বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপি'র ২৭.৪ শতাংশ হবে মর্মে আশা করছি। উল্লেখ্য, পরিসংখ্যান ব্যুরো ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব/উপাত্ত প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিয়ামক উপাদানসমূহের গতিধারা আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও নীতি-কৌশলে সমন্বয় সাধন সহজ হবে।”