বাংলাদেশ এখনও কমফোর্টেবল অবস্থানে আছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “বাইরের থেকে অনেকেই বলে কিছুই নাই, এত খারাপ অবস্থা না।
Published : 13 Aug 2024, 08:28 PM
গেল দু’বছর সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে চাপে থাকলেও বিশ্ব ব্যাংক কখনও বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ ছিল না জানিয়েছেন সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক।
একই কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও।
বৈদেশিক ঋণের স্থিতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও ‘কমফোর্টেবল’ অবস্থানে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাইরের থেকে অনেকেই বলে কিছুই নাই, এত খারাপ অবস্থা না। লোনের টাকা পরিশোধ করতে পারব না, এতটা খারাপ অবস্থা না।”
তবে আগে (শেখ হাসিনা সরকারের আমলে) ঋণ নেওয়ার মোটিভিশন ভিন্ন ছিল। তাই ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের আরও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন এ উপদেষ্টা।
মঙ্গলবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং পরে বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এসব বলেন সালেহউদ্দিন।
এ সময় বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কা বা উদ্বেগ আছে কি না এমন প্রশ্নে বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বলেন, “এটি নিয়ে কখনও উদ্বেগ ছিল না। গেল ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য অংশীদার।
“আমি বলতে চাচ্ছি, আমি অনেক দেশে, অনেক মহাদেশ জুড়ে উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি। এরপরও আমি (বাংলাদেশ নিয়ে) বলতে পারি যে, এটি কখনই উদ্বেগের বিষয় ছিল না।”
এ পর্যায়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা এখনও কোনো ঋণের ডিফল্ট করিনি। আমরা যেন সামনেও এটা না করি। তবে ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে লোনটা কেমন আসবে, সফট লোন নাকি হার্ড লোন দেখা। আমরা প্রেফার করব সফট লোন।
“কিছু পটেনশিয়াল প্রকল্পে হার্ড লোন নিতে হবে, সেটাও আমরা যাচাই-বাছাই করে নেব। সেক্ষেত্রে এটা যেন প্রোপার ইউজ হয়, সেটি বিচেনায় নিতে হবে।”
উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের কাঠামোগত সংস্কারে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিশ্রুতির কথাও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আবদৌলায়ে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনরায় ব্যক্ত করছি, যাতে আমরা বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি, তা আর্থিক হোক, খাত সংস্কার হোক, বাণিজ্য সংস্কার, বা ব্যবসার পরিবেশ হোক। যাতে করে বেসরকারি খাতের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।”
অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও জলবায়ু ঝুঁকি নীতির স্থিতিস্থাপকতা কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেন বিশ্ব ব্যাংকের এ কর্মকর্তা।
তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে বিশ্ব ব্যাংকের ৪২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি ও তার ইতিবাচক ফলে কথা স্মরণ করে বলেন, “আমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। আলোচনায় উপদেষ্টা ব্যর্থ না হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই স্ট্রং ছিলেন, আমি মনে করি যেমনটা সেসব তরুণরাও ছিলেন। তাই আমরা খুব উত্সাহিত এবং একসাথে কাজ করার জন্য উন্মুখ।”
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বের বিশ্লেষণ ও পরামর্শ নিয়ে তিনি বলেন, “এটি একটি ক্রিটিক্যাল এজেন্ডা। আমরা অনেক ধরনের সংস্কার কাজে সমর্থন দিচ্ছি, যা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
“জুনের শেষের দিকে আমরা নীতি ভিত্তিক ঋণ নিয়ে বোর্ডে আলোচনা করেছি। কিছু সংস্কারের আলোচনা করেছি। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক কোম্পানি আইন নীতিভিত্তিক ঋণের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু সেখানে বেশ কিছু সমস্যা ছিল, যা এখন সামনে আসছে।”
সরকার বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপকে আর্থিক খাতে সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে জানিয়ে এসময় ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের- আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার (বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল) মার্টিন হল্টম্যান বলেন, “একটি শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য শক্তিশালী আর্থিক খাত প্রয়োজন। আমি মনে করি যে সংস্কার প্রচেষ্টার উপর ফোকাস করা উচিত সে বিষয়ে সাধারণ চুক্তি রয়েছে।”
“বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাত হিসাবে আমরা (আইএফসি) ব্যাংকগুলোতে মূলধন বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত,” বলেন তিনি।
বর্তমানেও দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইএফসির বেশ কিছু বিনিয়োগ আছে বলেও তিনি জানান।
হল্টম্যান বলেন, “আমার এটাও উল্লেখ করা উচিত যে, ক্রমাগত ডিজিটাইজেশন ফ্রন্টে প্রচুর সুযোগ রয়েছে যেখানে বাংলাদেশ অতীতে মোটামুটি ভালো করেছে।”
ঋণের চাপ সামাল কীভাবে
ঋণ পরিশোধে দেশ গেল দু’বছর চাপে আছে, সেটা সামালে পরিকল্পনা করছেন কি না, এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সেটা আমরা করব। এগুলো তো আমরা না করতে পারব না। আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যেভাবে যে নিক। আমরা আমাদের এসব কমিটমেন্ট যেন ডিফল্ট না করি। কমিটমেন্ট যেটা আছে সেটা আমরা ফুলফিল করব।”
“আর আমি বলি আমাদের লোনের স্থিতি কিন্তু জিডিপির বিরাট অংশ না। এটা কিন্তু মনে রাখতে হবে। বহু কান্ট্রি কিন্তু হান্ড্রেড পারসেন্টের বেশি। গ্রিস, ইতালির তো ১০০ পার্সেন্টের বেশি। শ্রীলঙ্কার ছিল অনেক বেশি। আমাদের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ কত? তবে কম বলেই যে খালি নিতে থাকব সেটা না। আমাদের লোন পরিশোধের সামর্থ্য থাকতে হবে। ইউটিলাইজেশন করতে হবে। মোটামুটি আমরা কমফোর্টেবল তবে আরেকটু বেটার ম্যানেজ করতে হবে।”
কর্মকর্তাদের অতীত নিয়ে হতাশ
উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক কর্মকর্তাই প্রস্তুতি নেন না, কেবল বিদেশে যান ঘুরতে, এমন মন্তব্য করে উপেদষ্টা বলেন, “প্লেনে উঠল, মনে হল যাই ঘুরতে। আবার গিয়ে বসে এদিক-ওদিক তাকাল। এভাবে হবে না।
এজন্য সভায় কর্মকর্তাদের ঋণ নিয়ে আলোচনার আগে একটু পড়ে প্রস্তুতি নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “এখন প্রথম কাজ হচ্ছে, উই শুড ক্রিয়েট আ গুড ইমেজ। কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে কাজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি, তারাও কমিট করেছে এক্ষেত্রে কাজ করবে।
“দ্বিতীয়ত, আমি বলেছি, বাংলাদেশের বাহির থেকে অর্থ আসলেই যে আমরা নিয়ে নেব, আমাদের চাহিদা কী আছে, কোন প্রকল্প আমাদের দরকার, সেটা আমাদের দেখতে হবে। আসলেই যে আমরা নিয়ে নেব, তা না। ডোনাররা যদি দিতে চায়, আমরা ব্যাংকে যেমন ডিউ ডেলিজেন্স বলি, সেরকম সকল শর্ত, সুদের হার ও সুবিধা-অসুবিধা দেখতে হবে এবং তার ইউটিলাইজেশন করতে হবে।”
উপদেষ্টা বলেন, “বৈদেশিক টাকা থাকলে একটা টেন্ডেন্সি থাকে, আমাদের টাকা না। ৫০০ টাকার জিনিস ৫০০০ টাকা দিয়ে কিনে ফেলি, আমাদের টাকা না, বাইরের টাকা। অতএব এই বিষয়টা অ্যাড্রেস করবেন। পাইপলাইনে যে প্রজেক্টগুলো আছে, অনেকগুলো কমিটমেন্ট আছে, তা ছাড়াবার চেষ্টা করেন। যদি কোনো কোয়েরি থাকে আপনাদের দিক থেকে প্রশ্ন তোলেন, নয়তো আমাদের দিক থেকে তুলব।”
তিনি বরেন, “তাদেরকে (কর্মকর্তা) বলেছি, আপনারা আরেকটু বেশি পরিশ্রমী হোন। একটু ট্রান্সপারেন্সি রাখেন। দেশের কথা ভাবেন। রুটিন জব না, নন-রুটিন জবও করেন। কারণ এগুলো ডেভলপমেন্ট ওয়ার্কের সাথেও জড়িত।”