ডলারের চড়া দাম আর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের পর পশ্চিমাদের নানা নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা থেকে রক্ষা পেতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিকল্প বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক মুন্সি ফয়েজ আহমদ।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেছেন, “মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে যখন সারা বিশ্বের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন ব্যবস্থা (কারেন্সি সোয়াপ) গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি আমেরিকানরাও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত নিষেধাজ্ঞার ফলে।
“আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় ডলারের একাধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এখন ভুগছে। এ কারণে আমাদের দুবার ভাবা উচিৎ এবং এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ, যাতে আমরা ডলার এবং মার্কিন বিনিময় মাধ্যমের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারি।”
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ এ কথা বলছিলেন ফয়েজ আহমদ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং ফেইসবুকে (https://www.facebook.com/bdnews24) অনুষ্ঠানটি লাইভস্ট্রিম করা হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান ফয়েজ আহমদ মনে করেন, নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের বিকল্প গড়ে তুলতে পারলে তা রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের অনেক ক্ষতির মধ্যেও একটি ‘ইতিবাচক’ দিক হিসাবে আবির্ভুত হতে পারে।
তিনি বলেন, “সব ধরনের কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করছে যুদ্ধ, আমাদের ভোগাচ্ছেও। তবে, আমরা যদি এটাকে (ডলারে বিনিময়ের বাধ্যবাধকতা) এড়িয়ে যেতে পারি, তাহলে আমি মনে করি সেটা হবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার জন্য একটি ইতিবাচক অবদান।”
কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে এরই মধ্যে ব্যবসা করছে, সেকথা বলেন অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-চায়না অ্যালামনাইর (অ্যাবকা) সভাপতি ফয়েজ আহমদ।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চীনের প্রভাবের বিষয়েও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ফয়েজ আহমদ বলেন, বৈশ্বিক পরিসরে চীনের উপস্থিতি বাড়ার কারণ হচ্ছে তাদের অর্থনীতি বেশ বাড়ছে। চীন পরাশক্তি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকাতে চাইছে।
২০৪৯ সাল নাগাদ উন্নতি-অগ্রগতির দিক থেকে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের সমান অবস্থানে চীন পৌঁছবে বলে মনে করেন তিনি।
চীনের ঋণ নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে বলে মন্তব্য করে এক প্রশ্নে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “চীন থেকে ঋণ নেওয়া মানে এই না যে, আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্যায় পড়ে যাবেন। আপনি তখনই বিপদে পড়বেন, যখন আপনি ঠিকমত হোমওয়ার্ক করবেন না।
“আপনি যদি চীন বা অন্য কারও থেকে এমন প্রকল্পে অর্থ চান, যেটা ব্যবহার উপযোগী নয়, আর দ্রুত ফল আসবে না, তাহলে সেটা ফেরত দিতে আপনাকে বিপদে পড়তে হবে। যখন আপনি অন্যের কাছ থেকে ঋণ নেবেন, তখন আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে আপনি এটা ফেরত দিতে পারবেন এবং এর শর্তাবলী আপনার জন্য উপযোগী।”
নিজেদের অব্যাহত উন্নতির নিশ্চয়তা তৈরির জন্য চীন আন্তর্জাতিকভাবে শান্তির জন্য কাজ করছে বলে মনে করেন ফয়েজ আহমেদ। সৌদি আরব-ইরানের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সেক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘চিন্তায়’ ফেলে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “ভালো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করেছে চীন এবং আমি মনে করি তারা সফল হয়েছে। দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা সৌদি আরব ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সাহায্য করেছে তারা। এটা বেশ ভালো অগ্রগতি, কারণ অনেক লোক এটা যে সম্ভব তা ভাবেনি।
“আমেরিকানরা চোখ বড় বড় করে দেখছে এবং বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে যে, ‘আমরা তো কিছু করিনি, কিন্তু তারা কীভাবে পুনর্মিলন ঘটিয়েছে’। আমি মনে করি, আমেরিকানরা যথেষ্ট দুঃশ্চিন্তায় আছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মধ্যস্থতাকারী, একক মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তারা আর থাকতে পারছে না।”
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন ঘিরে চীন ও ভারতের সঙ্গে ঢাকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, এমন প্রশ্নে না সূচক উত্তর আসে সাবেক এই কূটনীতিকের।
তিনি বলেন, “ভারতের কত দূরে আর চীনের কত দূরে কিংবা ভারতের কত কাছে আর চীনের কত কাছে- এমন ভারসাম্য মেপে সরকার কাজ করছে না। আর এটা এভাবে কাজও করে না।”
ফয়েজ আহমদ বলেন, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিকে সরকার ‘ভালোভাবে’ অনুসরণ করছে।
“তার মানে এই নয় যে, কারও সঙ্গে আমাদের ঝামেলা নেই। আমাদের চীনের সঙ্গে সমস্যা আছে, ভারতের সঙ্গে আছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছে, প্রত্যেক অংশদীর দেশের সঙ্গেই আমাদের সমস্যা আছে। তবে আমরা সত্যিকার অর্থেই সব দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করতে পেরেছি। আমি মনে করি, সব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের সঙ্গেই আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে।”