বিদেশি বিনিয়োগ টানতে আর্থিক খাতে সুশাসনের তাগিদ

দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পুঁজিবাজারমুখী হওয়ার পরামর্শও আসে বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের আলোচনায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2023, 05:08 PM
Updated : 12 March 2023, 05:08 PM

বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে এজন্য আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের তাগিদ এসেছে দেশি-বিদেশি আলোচকদের কাছে থেকে।

ঢাকায় শুরু হওয়া তিন দিনের বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৩ এর দ্বিতীয় দিন রোববার ‘লং টার্ম ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনের আলোচনায় অংশ নেন তারা।

আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প তুলে ধরা হয়।

এদিন দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বিষয়ক অধিবেশনের মূল প্রবন্ধে শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ২০২০ সালে দেশে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ১৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে যেতে হলে ২০২০ সালেই আমাদের প্রয়োজন ছিল ১৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বিনিয়োগে ঘাটতি রয়েছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।

অপরদিকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে ২০৪০ সালের মধ্যে ৪৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ স্থিতির প্রয়োজন বলে তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন।

সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে ওই দেশের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, সুশাসন ও আর্থিক প্রতিবেদনের গুনগতমানের গ্রহণযোগ্যতাকে বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এজন্য এসব খাতের উন্নয়নে জোর দিতে হবে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে।

‘‘দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বড় সমস্যা। এখানে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন নেওয়ার চেয়ে ব্যাংক ঋণে বেশি ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনুমোদন যেকোনো বিষয়ে অনুমোদন পেতে সময় বেশি লাগায় পুঁজিবাজার বিমুখ দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলো।”

প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কম আসছে জানিয়ে আরিফ খান বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারতে হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

চলমান মেগাপ্রকল্পগুলো শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে। ভোক্তা শ্রেণির বাজারও সবচেয়ে দ্রুত বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

আলোচনায় এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগে কয়েকটি ঝুঁকির বিষয়ে আগেভাগেই মূল্যায়ন করে নেয়। প্রধানত তিনটি ঝুঁকি তথা মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার ঝুঁকিগত বিষয়, বিনিয়োগ থেকে মুনাফা প্রাপ্তি ও স্থানীয় ব্যাংক থেকে অর্থায়নের সুযোগগুলো বিবেচনায় নিয়ে থাকে।

‘‘আর্থিক খাতে সুশাসন, আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও গুণগতমানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি আশানুরূপ হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ কোনো সমস্যা নয়।’’

সৌদি আরবের এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ইয়াহইয়া আল হারথি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে স্বল্প মেয়াদের আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেওয়া ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে অর্থপাচার, অর্থায়নে সুশাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নত বিশ্ব বিবেচনায় নেয় বলে এসব দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

ব্রামার অ্যান্ড ক্যাপিটাল পার্টনারস (বাংলাদেশ) এর প্রধান নির্বাহী খালিদ কাদির বলেন, ‘‘ভোগ্যপণ্যের বাজার ও উৎপাদনের দিক দিয়ে চীনের পরই অবস্থান হতে পারে বাংলাদেশের। অনেক দেশেই স্বস্তা শ্রমবাজার রয়েছে। বিনিয়োগের জন্য কেন বিদেশি বিনিয়োগকারী এখানে আসবে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে তার সক্ষমতা দেখাতে হবে। বাংলাদেশের অনেক সম্ভবানা রয়েছে, সেগুলো তুলে ধরতে হবে তাদের কাছে।’’

আলোচনায় ব্যাংক খাতের জন্য খেলাপি ঋণ বড় সমস্যা বলে আরও কয়েক অতিথির ব্ক্তব্যে উঠে আসে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, স্বল্প মেয়াদের আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে। এখানে একটি মিস ম্যাচ রয়েছে, যা খেলাপি ঋণ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।

উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজারকে উৎস হিসেবে নিলে ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

খেলাপি ঋণকে ব্যাংক খাতের ‘ক্যান্সার’ উল্লেখ করে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র গোপন করার মত বিষয় নয়। যদি গোপন করা হয়, তাহলে সমস্যা থেকেই যাবে। কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে না। সুশাসনের ঘাটতিতেই খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়।’’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বাগত জানাতে সব ধরনের নীতি সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান।

সেশন পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘‘বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকদের সত্যিকার অর্থে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে।’’