টানা চার মাস কমে অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৪১ মাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে।
Published : 06 Dec 2024, 10:40 PM
সরকার পতনের পর নানা খাতে বিশৃঙ্খলা, নতুন বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের অনীহার মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ টানা চার মাস কমার তথ্য দিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, অক্টোবরে এই ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
করোনাভাইরাস মহামারীতে লকডাউন পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের মে মাসে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পর কখনও তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এও দেখা যাচ্ছে যে, জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রতি মাসেই ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে।
জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সরকার পতনের মাস আগস্টে তা নামে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ, সেটিও ছিল তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন সরকারের নানা নীতিমালা, ক্রমাগত শ্রমিক বিক্ষোভ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাজনীতিকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরকেও বিভিন্ন মামলার আসামি করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সুদহার ক্রমেই বাড়িয়ে দেওয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিসহ নানা কারণে নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা যে নিরুৎসাহী, সেটি নানাভাবেই প্রকাশ পাচ্ছিল।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে নতুন বিনিয়োগ করার সুযোগ নেই। বর্তমানে ব্যবসার যা অবস্থা তাতে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই করতে হচ্ছে পোশাক খাতের মালিকদের।”
তিনি বলেন, বলেন, “ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা নেই, তাছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ, তাতে বাড়ছে তহবিলের খরচ; অন্যদিকে গ্যাস সংকট থাকায় কাজ বন্ধ হয়ে আছে। গ্যাসের যে চাপ তা দিয়ে কারখানায় উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।”
যেসব শিল্প উৎপাদনে আছে, তাদের পরিস্থিতিও যে খুব একটা ভালো তা নয়, প্রায় চার মাস হয়ে গেল এমন সপ্তাহ যাচ্ছে না যেখানে বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা বিশেষ করে গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ায় বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করছে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালু থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে, এ জন্যই এত শ্রমিক বিক্ষোভ।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “শ্রমিকদের আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এদেশে বিনিয়োগ করতে চাইবে না।
“অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। তাই এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে।"
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সোহেল আর কে হুসেইনের মতামতও একই রকম। তিনি বলেন, “দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা-জাগান, ডলার দর ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবে।”
ঋণপ্রবাহ কমে গেলে কী হয়
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেলে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে।
আরও পড়ুন -
বিশৃঙ্খলা: 'অর্থনৈতিক মন্দার' শঙ্কায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা
'কেউ স্বস্তিতে নাই', এত সুদে ব্যবসা হয় না: সংলাপে ব্যবসায়ী নেতারা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বাজারে অর্থপ্রবাহ কমিয়ে রাখার যে নীতি ঠিক করেছে, ঋণপ্রবাহের এই প্রবৃদ্ধি তারও নিচে নেমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ব্যবসায়ীরা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ পর্যায়ে
ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবে ব্যবসার গতি শ্লথ হয়ে এসেছে।ব্যবসায়ীরা অনেক কিছু ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করছেন।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি বলেন, “ব্যবসায়ীরা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ পর্যায়ে রয়েছেন। দেশ ও বিদেশের জিনিসপত্রের দাম কী রকম, সেটারও একটা বিষয় রয়েছে। ভালো কোম্পানির পরিকল্পনা কিন্তু চলছে।”
পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা রকম ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য প্রচার হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মান নিয়ে এক রকম প্রশ্ন তৈরি করবে।
“রপ্তানি ও অন্যান্য খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেন কোনো রকম নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি বলে আমি মনে করি।”
সুদের হার বৃদ্ধিও ‘ধাক্কা’
অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এবিসিসিআই) সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জাম হোসেন মনে করেন, ক্ষমতার পালাবদলে রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছেন ব্যবসায়ীরা। ডলারের দর বেড়ে যাওয়া ও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধিও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
আরও পড়ুন -
সুদহার চড়ছেই, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১ মাসে সর্বনিম্ন, 'সাফল্য' দেখছেন জাহিদ হোসেন
তিনি বলেন, “ব্যাংক ঋণের সুদহার গুনতে হচ্ছে ১৫ শতাংশের মত। কোনো ব্যবসায়ী তো লোকসান করে ব্যবসা করবে না। তাই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে।”
সুদের হার বৃদ্ধির কারণ সরকারের আর্থিক নীতি। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ২২ অক্টোবরের রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট বাড়ায় মূলত টাকার সরবরাহ কমানোর জন্য। টাকার সরবরাহ কমালে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার টুল হিসাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে নীতি সুদহার বাড়ায় ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বেড়ে যায়।আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়নি আগেও।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি অবশ্য আশাবাদী যে এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি আবার ঘুরে যাবে। এবিসিসিআইয়ের সভাপতিও একই মত দিয়েছেন। তবে সে জন্য ব্যবসার পরিবেশ আরও ভালো করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।