সিত্রাং: জালও গেছে জলে, এখন জলে যাবে কী করে?

সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠছে, কিন্তু সিত্রাংয়ের পর চট্টগ্রামের সাগরকূলের জেলেপাড়ায় হাসি ফিরছে না।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2022, 06:28 AM
Updated : 28 Oct 2022, 06:28 AM

বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গেছে চট্টগ্রামের আউটার রিং রোড। এই সড়কের মাঝামাঝি এক জায়গায় আকমল আলী ঘাট, যেখানে বসবাস শতাধিক জেলে পরিবারের। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে এই জেলেপাড়ার পুরোটাই।

সব কিছু হারিয়ে এখন বেড়ি বাঁধের পাশে পলিথিন আর কাপড় দিয়ে ছাপড়া ঘর বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এই পাড়ার বাসিন্দারা।

২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হবে সাগরে মাছ ধরা। মাছ ধরেই চলে এই পাড়ার জীবন। কিন্তু এবার জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘরের পাশাপাশি তলিয়ে গেছে জাল, ভেঙেছে ট্রলার।

অন্য বছরগুলোতে যখন এই সময়ে জেলেপাড়ায় থাকে সাগরে যাওয়ার সাজ সাজ রব; এবার সেখানে বাজছে আক্ষেপের সুর।

জাল নেই, ট্রলার নেই, কী করে যাবেন মাছ ধরতে? আর মাছ ধরতে যেতে না পারলে কী করে চলবে সংসার, সেটাই এখন বড় ভাবনা জেলে পাড়ার বাসিন্দাদের মনে।

বেড়িবাঁধের নিচে সাগর পাড়ে অন্তত ২০০ পরিবারের বসবাস ছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। ছিল জেলেদের মালামাল রাখার ঘর, দোকানসহ আর বিভিন্ন স্থাপনা। সোমবার রাতে ঘণ্টাখানেকের ঝড়ো হাওয়া আর জলোচ্ছ্বাস তাদের করেছে নিঃস্ব।

Also Read: চট্টগ্রামে সিত্রাং: জোয়ারে ভেসেছে ফসলি জমি, মাছের ঘের, বসতঘর

অন্ন জুটছে কোনো মতে

সিত্রাং আঘাত হানার তিন দিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন সূর্য মাঝ আকাশে, তখন বেড়িবাঁধের একদিকে দেখা গেল রান্নার আয়োজন, আর পাশের জলাধারে লোকজন খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের হারিয়ে যাওয়া সম্বলটুকু। যেটুকু জাল রক্ষা পেয়েছে, সেটা মেরামতে ব্যস্ত ছিলেন কেউ কেউ। ঘরের নারীরা ব্যস্ত ঘূর্ণিঝড়ে রক্ষা করতে পারা তাদের গৃহস্থালি সরঞ্জামগুলো ঠিক করতে।

বেড়িবাঁধে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু নারী সামনে এসে অনুরোধ করতে লাগলেন, তাদের নাম যেন লেখা হয়। তারা বলছিলেন, তিন দিন পার হলেও সরকারি কোনো সহায়তা তারা পাননি।

বেড়ি বাঁধে যখন রান্না হচ্ছিল, তার তদারকি করছিলেন হরি দাস নামে এক ব্যক্তি। তিনি বললেন, ঘর, সহায়-সম্বল হারানো লোকজনের জন্য একসঙ্গে খাবার রান্না চলেছে সেখানে।

ওই এলাকায় প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় উত্তরায়ন সংক্রান্তি মহোৎসব ও সাগরদ্বীপ মেলা। মহোৎসব কমিটির তহবিলে যে অর্থ ছিল, তা দিয়েই তিন দিন ধরে রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে।

হরি দাস বলেন, “বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি থেকেও কয়েক বেলা খাওয়ার পাঠানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলো আসে অনেক দেরিতে। দুপুরের খাওয়ার আসে বিকালে, রাতের খাওয়ার আসে অনেক রাতে। ওই সময়েও খাওয়া যায় না। বড়রা কষ্ট করতে পারলেও ছোটরা পারে না। তাদের জন্য রান্না করতে হয়।”

প্রতি বেলায় দুই থেকে আড়াইশ জনের খাবার ব্যবস্থা হয়। খরচ হয় প্রতি বেলায় ১২-১৫ হাজার টাকা। এখন তহবিলের টাকাও শেষ।

হরি দাসের সঙ্গে কথা বলার সময় তার পাশ থেকে কথা বলে উঠলেন শিমুল দাশ নামে আরেক জেলে।

শিমুলের আক্ষেপ, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার থেকে যে চাল সহায়তার কথা বলা হয়েছিল, সে চাল পাওয়া গেছে বুধবার। তার বাইরে মঙ্গলবার এক ব্যক্তি আধা কেজি করে চিড়া, দুটি করে মোমবাতি, একটি করে দিয়াশলাই, এক প্যাকেট করে বিস্কুট দিয়ে গেছেন। তার বাইরে আর কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রশাসনের কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি।

বেড়িবাঁধ ধরে কিছু দূর যেতে দেখা যায়, একটি ছাপড়া ঘরে বসে সন্তানকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন এক নারী।

তিনি জানালেন, তার পরিবারে সাতজন সদস্য। দুই কক্ষের ঘরটি তলিয়ে গেছে পানিতে। কিছু মালামাল সরাতে পারলেও বেশিরভাগই তলিয়ে গেছে। ঘরের পুরুষ সদস্যদের কেউ গেছে হারিয়ে যাওয়া জাল খুঁজতে, আর কেউ গেছেন ভেঙে পড়া ট্রলার ঠিক করতে।

হৃদয় দাস নামে একজনকে দেখা গেল তার চার সহযোগীকে নিয়ে জাল ঠিক করতে ব্যস্ত।

তিনি জানালেন, যারা এখানে বাস করেন, তাদের সবার ঘরেই মাছ ধরার জাল ছিল। সবগুলোই ভেসে গিয়েছিল পানিতে। তার কাছে ৫০টি জাল ছিল। তার মধ্যে ২০টা পাওয়া গেলেও বাকিগুলোর সন্ধান মেলেনি।

হৃদয় বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত দিলেও তারা সবাই ঘরে ছিলেন। সন্ধ্যা থেকে সাগরে পানি বেশি ছিল। রাত সাড়ে ৮টার দিক থেকে পানি বাড়তে শুরু করে। ৯টার পর শুরু হয় জোয়ার। ঝড়ো বাতাস আর পানিতে তলিয়ে যায় সব।

এসময় অঞ্জলী দাস নামে এক নারী তার মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে বললেন, “আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। ছেলে-বৌ আর দুই নাতিকে নিয়ে আমাদের সংসার। হঠাৎ পানিতে আমাদের সবকিছু নিয়ে গেল। ঘরের সকল জিনিসপত্র পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কিছু জাল ছিল, সেগুলোও তলিয়ে গেল।”

অঞ্জলির ছেলে ও নাতি হারিয়ে যাওয়া জাল ও ভেঙে যাওয়া নৌকা ঠিক করতে গেছেন। উৎসব কমিটির আয়োজন করা রান্না থেকে চলছে তাদের খাওয়া। অন্য কোনো সহায়তা পাননি।

জেলেপাড়ার চা দোকানি মো. ইউসুফ গত ১০ বছর ধরে সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। এমন ঝড় তিনি আগে দেখেননি।

ইউসুফ বলেন, “দুই রুমের মধ্যে সামনের রুমে দোকান আর পেছনে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতাম। বাতাস ও পানির স্রোতে সবকিছুই তলিয়ে নিয়ে গেছে। দোকানে ২০/২৫ হাজার টাকার মত পুঁজি ছিল সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। এখন উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে যে রান্না হয়, সেগুলো খেয়ে দিন পার করছি।”

জেলেপল্লীর মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি জানালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আকমল আলী ঘাট জেলেপাড়া, বেড়ি বাঁধ এবং দক্ষিণ হালিশহর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মোট ৩০০ পরিবারের জন্য ৩ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

“আজ গোডাউন থেকে চাল ছাড় করাতে দেরি হয়ে গেছে। কাল (শুক্রবার) চাল বিতরণ করা হবে স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে।”

ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রান্না করা এবং শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় সঙ্গী দুশ্চিন্তা

ঝড় আসে, ক্ষতি করে দিয়ে যায়, তা থেকে আবার উঠে দাঁড়ানোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই চলে সাগর পাড়ের জেলেদের জীবন। কিন্তু এবার ক্ষতিটি বেশিই দেখছেন এখানকার জেলেরা। তার মধ্যেই ঝড়ের ক্ষত ভুলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।

জেলেপাড়া ধরে সাগরের কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখা গেল কয়েকজন মিলে বাঁশ কেটে ঘর তৈরির কাজ করছেন।

তাদের একজন রাখাল দাশ জানালেন, তাদের চার ভাইয়ের চারটি ঘর ছিল পাশাপাশি। পরিবারের কেউ কেউ বাসা ভাড়া নিয়ে বেরি বাঁধের উপরের এলাকায় থাকলেও কিছু সদস্য থাকতেন সাগর পাড়ের ঘরে।

ওই ঘরগুলোতে তাদের জাল, মাছ ধরার নৌকার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন মালামাল ছিল। পানিতে সবকিছু ভেসে গেছে।

রাখালদের চার ভাইয়ের চারটি ট্রলার সাগর পাড়ে একসঙ্গে বাঁধা ছিল। স্রোতের তোড়ে তার মধ্যে দুটি একেবারেই ভেঙে গেছে।

আকমল আলী ঘাটে যতগুলো জেলে পরিবার, তার প্রায় সমান পরিমাণ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছিল বলে জানান স্থানীয়রা।

মৃদুল জলদাস নামে একজন জানান, মাছ ধরার পাশাপাশি ট্রলার মেরামতের কাজও করতেন তিনি। সেখানে একটি তার দোকান ছিল। সব ভেসে গেছে।

তিনি জানান, তার যে ৩৫টা জাল ছিল, তার মধ্যে ১৭টা পাওয়া গেলেও বাকিগুলো পাওয়া যায়নি।

সাগরের পানিতে তলিয়ে গেছে মৃদুলের দোকানের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ। দুটি নৌকার মধ্যে একটি নৌকা পুরোপুরি ভেঙে গেছে।

রাখাল বলেন, জেলেদের প্রায় সবাই বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসা এবং মাছ ধরার কাজ করেন। এতদিন মাছ ধরা বন্ধ ছিল, শুক্রবার রাত থেকে মাছ ধরা পুনরায় শুরু হবে। তার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে গেলে।

রাখালের ভাষ্যে, “সাপ্তাহিক কিস্তি নিয়ে আমরা বিনিয়োগ করি। আগের অনেক টাকা ঋণ আছে। তার উপর এবার মাছ ধরতে যাওয়ার আগে সবকিছুই ভেঙে গেল। আবার নতুন করে ঋণ করতে হবে আমাদের।

“চোখে সামনের কোনো পথ দেখছি না। কীভাবে কী করব… ঘর ঠিক করতে হবে, ট্রলার ঠিক করতে হবে। না হলে মাছ ধরতেও যাওয়া যাবে না। আর কাজে যেতে না পারলে আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? আবার ঋণের টাকা পরিশোধেরও তাগদা আসবে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি।”