ডেঙ্গু: সময় ও উপসর্গে পরিবর্তন ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের

গত তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ডায়রিয়া ও কাশির মত উপসর্গও দেখা গেছে। ফলে ডেঙ্গু না কোভিড– তা বুঝতে দুই ধরনের পরীক্ষাই করাতে হয়েছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2022, 04:33 AM
Updated : 1 Nov 2022, 04:33 AM

সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর– এই চার মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকত আগে, অক্টোবরে রোগী কমতে শুরু করত। চট্টগ্রাম জেলায় এ বছর অক্টোবরে নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে সেপ্টেম্বরের তুলনায় তিনগুণ।

এ বছর অসময়ের বৃষ্টি এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। তবে বৃষ্টির পাশাপাশি শুকনো মৌসুমের শুরুতে বাড়তি আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা অনুকূলে থাকা এবং প্রাণীদেহের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাব্যতা সংক্রমণ বাড়াতে পারে বলে তাদের ধারণা।

গত তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ডায়রিয়া এবং কাশির মত উপসর্গও দেখা গেছে। পাশাপাশি রক্তের অনুচক্রিকা খুব দ্রুত কমছে এবং তা কম থাকছে বেশিদিন ধরে।

চলতি বছর চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৬৭৬ জন। তাদের ১ হাজার ৯৫৯ জন চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দা এবং ৭১৭ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। তাদের ১ হাজার ৩৪৬ জন পুরুষ, ৭০২ জন নারী এবং ৬২৮ জন শিশু।

কেবল অক্টোবর মাসেই ১ হাজার ৮৬১ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে গেছেন এ জেলায়; এ বছর এক মাসের হিসাবে এটাই সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বর মাসে ৬০১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন ৮৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৮৪ জন। 

এ বছর চট্টগ্রাম জেলায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এর মধ্যে ৩ জন পুরুষ, ৭ জন নারী এবং শিশু ৪ জন।

সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াছ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনো দিনে গড়ে ৮০-৯০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অন্য বছরগুলোতে অক্টোবরে সংক্রমণ কমতে থাকে। এ বছর অক্টোবরে আক্রান্ত সেপ্টেম্বরের তুলনায় তিনগুণ বেশি। ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সংক্রমণের হার দেখলে বোঝা যাবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, শুধু যে চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা নয়, ঢাকায়ও বাড়ছে। লোকজন নিয়মিত আসা-যাওয়া করছে বড় শহরগুলোতে। কেউ কেউ এক জায়গায় আক্রান্ত হয়ে অন্য জেলায় যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) সহযোগী অধ্যাপক মো. মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, এ বছরের প্রবণতা তাকে উদ্বিগ্ন করছে।

“২০০০ সাল থেকে প্রতিবছরই ডেঙ্গু হচ্ছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রবণতাটা ছিল জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোগী বাড়বে। অক্টোবরে কমবে। নভেম্বরে খুবই কম থাকবে। গত ২২ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম অক্টোবরে সংক্রমণ কমার বদলে বাড়ছে।”

চলতি বছর অনেক লম্বা সময় ধরে অনিয়মিত বৃষ্টি হয়েছে। সিত্রাংয়ের প্রভাবে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ‍গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। গত কয়েক মাস তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং আর্দ্রতা ৮০ শতাংশের আশপাশে।

সংক্রামক রোগ নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে ডা. মামুন বলছেন, এমন আবহাওয়া এইডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য খুবই সহায়ক।

“এইডিস মশার ডিম প্রকৃতিতে ১ থেকে ৩ বছর অক্ষত থাকে। অনুকূল পরিবেশে ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হতে পারে। এসব কারণে সংক্রমণ বেশি হতে পারে। মানুষের পাশাপাশি গরু, শুকর ও বাদুড় ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হিসেবে প্রমাণিত। এটাও সংক্রমণ বাড়ার একটা কারণ হতে পারে।”

বিআইটিআইডিতে অগাস্টে ২০ জন, সেপ্টেম্বরে ১০৭ জন এবং অক্টোবরে প্রায় ২০০ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

ডা. মামুন বলেন, “আগে জ্বর, ব্যথা, গায়ে র‌্যাশ ওঠা, রক্তচাপ কম থাকা ও ফুসফুসে পানি আসা ছিল ডেঙ্গুর উপসর্গ। এখন যোগ হয়েছে ডায়রিয়া ও কাশি।

“ফলে রোগী কোভিড আক্রান্ত নাকি ডেঙ্গুতে, তা বুঝতে দুই ধরনের পরীক্ষাই করাতে হচ্ছে। চলতি বছর রোগীদের রক্তের প্লাটিলেট অনেক বেশি কমে যাওয়া এবং তা অনেকদিন ধরে কম থাকা আরেকটি প্রবণতা। ডেঙ্গু সংক্রমণের সময়কাল ও প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।”

গত ৮ মাসে জেলায় মশক জরিপ না হলেও চট্টগ্রাম জেলার কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওছ বলছেন, এখন মশার সংখ্যা বেশি বলেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে– পরিস্থিতি তেমন নয়।

“অসময়ের বৃষ্টি, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এবং বাহক– এই চারটি সূচক অনুকূলে থাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখন বেশি।”

উপজেলাগুলো থেকে মশার নমুনা সংগ্রহ এবং সচেতনতামূলক প্রচারের কাজ চলছে জানিয়ে ফেরদাওছ বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে মশক জরিপ এখনই হয়ত হবে না। তবে উপজেলার নমুনা সংগ্রহ শেষ হলে তারা নগরীতে স্থানীয়ভাবে জরিপের কাজ শুরু করতে চান।

“এইডিস মশা একইসাথে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা ভাইরাসের বাহক হতে পারে। সে কারণে সতর্ক থাকা খুব জরুরি। এ মশা দিনের বেলায় একবারে গড়ে তিনজন মানুষকে মশা হুল ফোটায়। তাই এক্ষেত্রে সচেতনতা খুব জরুরি।”

সচেতনতায় জোর দিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও(সিসিসি)। নানামুখী সমালোচনার পর সপ্তাহখানেক আগে লার্ভিসাইড হিসেবে নতুন একটি ভেষজ ওষুধ ব্যবহার শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী ভেষজ লার্ভিসাইড ব্যবহারে সুফল পাচ্ছি। নাগরিক সচেতনতায় ছাদ বাগান পরিষ্কার রাখা, ফুলের টব ও এসির পানি জমতে না দেওয়া এবং নির্মাণাধীন ভবনে পানি যাতে না জমে, সেজন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রচারের পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।”

এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ও কৃষি বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী।