হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বিদেশে, ‘চাঁদাবাজি’ দেশে

চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় এমন ঘটনার জন্য এক সময়ের ‘শিবির ক্যাডার’ সাজ্জাদ হোসেনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ।

উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2022, 06:49 PM
Updated : 27 July 2022, 06:49 PM

হুলিয়া নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েও টেলিফোনে দেশে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করছেন চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন। এমন কথাই বলছেন চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলী এলাকায় একটি তোষক কারখানায় আগুন দেওয়ার পর আবার আলোচনায় এসেছেন সাজ্জাদ।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে তার সহযোগীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-বাড়িতে গিয়ে চাঁদা দাবি করেন। দাবি মতো টাকা না পেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সেসব প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়িতে। আর বিদেশে বসে পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন সাজ্জাদ।

চালিতাতলী এলাকারই আব্দুল গণি কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাজ্জাদের নাম আলোচনায় আসে গত শতকের ৯০’র দশকের শেষ দিকে। তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত এই যুবক খুনসহ অনেক মামলার আসামি হন।

২০০০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামে আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী হত্যায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ড পেয়েছিলেন সাজ্জাদ। পরে উচ্চ আদালত থেকে এ মামলায় খালাস পান।

তবে তার আগে গ্রেপ্তার এড়াতে ২০০২ সালের দিকে সাজ্জাদ দুবাই পালিয়ে যান বলে গুঞ্জন আছে। তাকে ধরতে ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিস’ এখনও ঝুলছে।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি, আব্দুল্লাহ নাম ধারণ করে পরিচয় লুকিয়ে সাজ্জাদ দুবাই থেকে ভারতে গিয়ে অবস্থান নেয়। বছর কয়েক আগে সে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে জামিনে ছাড়া পায়।”

সাজ্জাদের ‘নির্দেশে’ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি করার প্রমাণ পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে যারা, তাদের ধরতে পারলেও সাজ্জাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

গত ২০ জুলাই চালিতাতলী এলাকায় যে মেট্রেস কারখানায় আগুন দেওয়া হয়েছিল, তার মালিকের কাছে ঘটনার দুই দিন আগে সাজ্জাদের পরিচয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল একটি বিদেশি নম্বর থেকে।

ওসি কামরুজ্জামান বলেন, “ইন্টারনেটে ও বিদেশি ফোন নম্বর থেকে সাজ্জাদ নিজের পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করেন। দাবি মতো টাকা না দিলে তখন তার দলের সদস্যরা চাঁদা দাবি করা লোকজনের বাসায় কিংবা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পেট্রোল বোমা ছোড়ে অথবা অন্য কোন উপায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।”

সে ঘটনায় জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা বিদেশে থাকা ‘সাজ্জাদের নির্দেশে’ আগুন দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

Also Read: চট্টগ্রামে চাঁদা দাবির পর কারখানায় আগুন, গ্রেপ্তার ২

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর সাজ্জাদের ‘চাঁদাবাজির উৎপাত’ আরও বেড়ে গেছে। তার চাঁদাবাজি চলে মূলত বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া, চালিতাতলী, হাজীরপুল, চান্দগাঁও এলাকার শমসের পাড়া, পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকায়।

সবাই অভিযোগও করেন না বলে জানান ওসি কামরুজ্জামান।

“বিভিন্ন সময়ে প্রবাসীদের ফোন করে সাজ্জাদের চাঁদা দাবির বিষয়টি জানালেও কেউ অভিযোগ করতে আসে না পুলিশের কাছে। সমঝোতা করে টাকা পরিশোধ করে দেন। চাঁদা না দিলে যখন হামলার ঘটনা ঘটে, তখন আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন।”

গত ১১ এপ্রিল বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া এলাকায় এক প্রবাসীর বাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় একটি মামলা হয় থানায়।

সে মামলার বাদী অভিযোগ করেন, তিনি তার নিজের জায়গায় ভবন নির্মাণ করছিলেন। ২০ মার্চ দুপুরে একটি বিদেশি নম্বর থেকে তার স্ত্রীর মোবাইলে সাজ্জাদ পরিচয়ে ফোন করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ক্ষতি করার হুমকি দেয়।

ওই ব্যবসায়ীর কাছে দুই দিন পর দেশীয় একটি মোবাইল নম্বর থেকে ফোন আসে। আগের দাবি করা এক লাখ টাকা না দেওয়ায় ১০ লাখ টাকা দাবি করে ওই ফোন আসে। বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব না দেওয়ায় গত ১০ এপ্রিল গভীর রাতে তার বাসায় দুটি পেট্রোল বোমা ছোড়ে অটোরিকশা নিয়ে আসা চার ব্যক্তি।

ওসি কামরুজ্জামান জানান, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী প্রবাসী সাজ্জাদের বড় ভাই ওসমান আলী সেগুন, আজাদ ও মো. সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন।

Also Read: ভারত থেকে চাঁদা দাবির পর চট্টগ্রামে প্রবাসীর বাড়িতে পেট্রোল বোমা

এর আগে ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল ভোরে পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকায় একটি ভবনে পেট্রোল বোমা ছোড়ার ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পর বাড়ির বাসিন্দা প্রবাসী নুরুল আক্কাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নগরীর চান্দগাঁও হাজীরপুল এলাকায় আট মাস ধরে তাদের নিজস্ব একটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল। ভবন থেকে একটি ফ্ল্যাট অথবা এক কোটি টাকা দাবি করে দুবাইয়ে থাকা তার বড় ভাই নুরুল আবসারকে ফোন করেন সাজ্জাদ।

পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “নগরীতে ভবন নির্মাণ কাজে তাদের কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু ভারতীয় নম্বর থেকে দুবাইতে নুরুল আবসারের কাছে সাজ্জাদ নাম দিয়ে একজন ফোন করেছিল।”

এ ঘটনায় পুলিশ সাজ্জাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছে আদালতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাজ্জাদের হয়ে চট্টগ্রামে যারা চাঁদা দাবিসহ অপরাধমূলক কাজে জড়িত তাদের মধ্যে অন্যতম তার ভাই ওসমান আলী সেগুন। এছাড়াও আছেন আজাদ, আজিজ, বেলাল উদ্দিন মুন্না।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, চালিতাতলী, ওয়াজেদিয়া, হাজীরপুল, শমসের পাড়া এলাকার বিভিন্ন অভাবি মানুষকে সাজ্জাদের হয়ে আজিজ আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। পরে তাদের ব্যবহার করা হয় সাজ্জাদের চাঁদা আদায় এবং হামলার ঘটনায়।