গোটা অঞ্চলের শিল্পায়ন, নগরায়ন ও পর্যটনে এই টানেল অবদান রাখবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
Published : 27 Oct 2023, 09:36 PM
সড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন আর শিল্প-বাণিজ্যে গতি আনতে সাত বছরের নির্মাণযজ্ঞ শেষে বাস্তব অবয়ব পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল; এর মাধ্যমে শিল্প, নগরায়ন ও পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনা দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
এ টানেলের পরিপূর্ণ সুফল পেতে প্রয়োজন আরও কিছু অবকাঠামো, দ্রুত সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে চট্টগ্রাম-কক্সাবাজারের বিশাল এলাকা ‘আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রে’ পরিণত হবে বলেই মনে করেন তারা।
তবে এই সুফল পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে জানিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এর ব্যবহার বাড়বে, যখন বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর পুরোপুরি চালু হবে।
“পাশাপাশি যখন মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর থেকে টানেল হয়ে আনোয়ারা-বাঁশখালী ও কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভের কাজ শেষ হবে, তখনই পুরো সুফল আসবে। তাই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের উদ্যোগ দ্রুত গ্রহণ করা জরুরি।”
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই টানেল পুরো অঞ্চলে শিল্পায়ন, নগরায়ন ও পর্যটনে বড় অবদান রাখবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মইনুল ইসলাম।
তার কথায়, “মেরিন ড্রাইভ হয়ে গেলে তখন মেরিন ড্রাইভের দুই পাশে অনেক ইপিজেড গড়ে উঠবে। প্রয়োজনে মেরিন ড্রাইভের পাড় ঘেঁষে সুবিধামত স্থানে আরও বন্দরও গড়ে তুলতে পারব আমরা। পাশাপাশি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সুফল পেতে এই টানেল অনেকখানি সহযোগিতা করবে। গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ শেষ হলে টানেলের সুফল অনেকটাই পাওয়া যাবে।”
১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ টানেল শনিবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পরদিন সকাল থেকেই এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
টানেলটি দেশের অন্য অংশের সঙ্গে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর এবং ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর’ মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে জাপানসহ বিভিন্ন দেশ চট্টগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে লক্ষ্য করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কর্ণফুলীর অপর পারে নগরায়নের পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত গড়ে উঠবে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান যা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।”
প্রকল্পের সুফল পেতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
“মিরসরাইয়ে দেশের বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে কর্ণফুলীর দুই পাড়ের মধ্যে বিকল্প সংযোগের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে এই টানেল বাস্তবায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”
প্রয়োজন পরিকল্পিত নগরায়ন
বঙ্গবন্ধু টানেল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নয়ন ঘটাবে মন্তব্য করে ব্যবসায়ী সমিতির নেতা মাহবুবুল আলম বলেন, “পরিপূর্ণ সুফল পেতে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে করতে হবে পরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন। পাশাপাশি বে-টার্মিনাল প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৮ লেইন মহাসড়ক, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রকল্প, সাবরাং ট্যুরিজম প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
“সঠিক সময়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে টানেলের পরিপূর্ণ সুফল মিলবে না। এজন্য অতি শিগগিরিই একটি ডিটেইলড মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি।”
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ও আরএসবি ইন্ডাস্ট্রিয়ালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ মনে করেন বন্দর নগরীর ওপর চাপ কমাতে চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশে নতুন শহর গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে এ টানেল।
“সেজন্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হবে। তাতে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ ধারণা বাস্তবায়ন হবে। দক্ষিণে রপ্তানিমুখী বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনের বিষয়েও জোর দিতে হবে।
“পাশাপাশি কক্সবাজার-মাতারবাড়ি পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ করতে হবে। মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের প্রস্তাবিত ইপিজেডগুলোকে কানেক্ট করতে হবে। কক্সবাজার-মহেশখালী বেল্টে ব্লু ইকোনমির শিল্প উদ্যোগগুলো শুরু হলে টানেল সেই পথের যাত্রাকে সুগম করবে।”
ব্যবসায়ী নেতা অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, “এখন কেইপিজেড ও প্রস্তাবিত চায়না ইকোনোমিক জোন থেকে টানেল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের পথে আসা-যাওয়ার সময় অনেক কমে যাবে ও সাশ্রয়ী হবে।
“কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, বিমানবন্দর ও ট্যুরিজম জোন হলে টানেল ব্যবহার করে সারাদেশের মানুষ সেখানে পর্যটনের জন্য যাবে। এমনকি বিদেশি পর্যটকও আসবে। কাজেই এখনই সংশ্লিষ্ট সব খাতে পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে।”
কর্ণফুলী নদীতে পলি জমা একটি বড় সমস্যা। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম নির্ভর করে এই নদীর নাব্যতার ওপর। তাই কর্ণফুলীতে তৃতীয় কোনো সেতু নির্মাণ না করে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং বাণিজ্য নগরী। টানেলটি চট্টগ্রাম নগরীকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করছে। এটি নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা এবং মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করা। পাশাপাশি ঢাকা-চট্রগ্রাম-কক্সবাজার এর মধ্যে নতুন একটি নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা।
টানেল প্রকল্পের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাবে কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন হবে; পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে। তাতে ভ্রমণ সময় ও খরচ কমবে। নদীর পূর্ব পাড়ের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে। নদীর পূর্ব পাড়ে বিকশিত হবে পর্যটন শিল্প।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, “শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার নয়, পুরো দেশে টানেলের প্রভাব পড়বে। বঙ্গবন্ধু কন্যার এই সাহসী উদ্যোগের সুফল ভোগ করবে বাংলাদেশ।”