“এখন আপনারা ছবি তুলে কি করবেন? ছবি তুলে কি আমার স্বামীকে ফেরত এনে দিতে পারবেন? সে কি দোষ করেছিল,” আহাজারি করে বলছিলেন তার স্ত্রী।
Published : 17 Jul 2024, 12:14 AM
চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর এলাকায় হোটেলে ভাত খেয়ে নিজের কর্মস্থলে ফেরার সময় কোটাবিরোধী আর সরকারসমর্থকদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন ফার্নিচার দোকানের কর্মী মো. ফারুক।
ফারুক নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী এলাকার মো. দুলালের ছেলে। পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজারের পানির ট্যাংকি এলাকায় তিনি থাকতেন।
পেশায় রট আয়রনের মিস্ত্রি ফারুক এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার ছেলে ফাহিম (১২) নগরীর বাগমনিরাম সিটি করপোরেশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর মেয়ে ফাহিমা (৭) মহিলা সমিতি বালিকা বিদ্যালয়ের কিন্ডারগার্টেন শাখার কেজি শ্রেণির ছাত্রী।
স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে শ্বশুরের সাথে চট্টগ্রাম মেডিকে কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছুটে যান ফারুকের স্ত্রী সীমা আকতার।
এসময় সাংবাদিকরা তার ছবি তোলার চেষ্টা করলে সীমা আহাজারি করতে করতে বলেন, “এখন আপনারা ছবি তুলে কি করবেন? ছবি তুলে কি আমার স্বামীকে ফেরত এনে দিতে পারবেন? সে কি দোষ করেছিল?”
তিনি বলেন, সকালে ৮টার সময় সকালের নাস্তা করে বাসা থেকে দোকানে গিয়েছিলেন ফারুক। কাজ শেষে তার বাসায় ফেরার কথা ছিল রাত ১০টার পর।
“দুপুরে ভাত খেতে দোকান থেকে বের হয়েছিল। এরমধ্যে সব শেষ হয়ে গেল।”
আহাজারি করে সীমা বলতে থাকেন, “আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে এখন কী করব। আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।”
গত ১৫ বছর ধরে নগরীর শুলকবহর এলাকার এসএস ফার্নিচার নামে একটি রট আয়রনের আসবাব তৈরির দোকানে কাজ করে আসছিলেন ফারুক।
তার সহকর্মী ফরহাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফারুক ভাই সকাল থেকে আমাদের সাথে কাজ করেছে। দুপুরে ভাত খাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। সেখান থেকে আবার দোকানে আসার সময় মারামারির ভিতর পড়ে যায়। বিকাল ৪টার দিকে আমরা খবর পাই ফারুক ভাই মারা গেছেন।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা এদিন দুপুরে ষোলশহর রেল স্টেশনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে আগে থেকে অবস্থান নিয়ে ছিলেন সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আন্দোলনকারীরা ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলে মুরাদপুর মোড়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা হয়। পরে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে ওই এলাকা থেকে তিনজনকে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, তাদের মধ্যে ফারুক একজন।
অন্য দুজন হলেন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ওয়াসিম আকরাম এবং ওমরগণি এমইএস কলেজের ছাত্র ফয়সাল আহমদ শান্ত।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম কক্সবাজার জেলার পেকুয়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মাহের নামা গ্রামের সবুর আলমের দুই ছেলের মধ্যে ছোট। তার বাবা সবুর আলম ও বড় ভাই দুবাই প্রবাসী।
ওয়াসিমের চাচা শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওয়াসিম কলেজে পড়তেন এবং বহদ্দারহাটের এক বাসায় থাকতেন। তার মা ও তিন বোন থাকেন গ্রামের বাড়িতে।
বিকেলে ওয়াসিমের মোবাইল থেকে কেউ একজন বিদেশে তার বাবার কাছে ফোন করে জানান তার ছেলে গুরুতর আহত।
“ওই খবর পেয়ে আমরা এখানে এসেছি। এখানে এসে দেখি ওয়াসিম মারা গেছে,” বলেন শামসুল আলম।
ওয়াসিমের সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, “ওয়াসিমকে আজ যেতে মানা করেছিলাম। গতকালও সে আন্দোলনে গিয়েছিল। এখন তার পরিবারকে আমি কী জবাব দেব।”
ওয়াসিমের স্বজন পরিচয় দেওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আজকে আন্দোলনে গেলে ছাত্রলীগের ছেলেরা ওকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এবং পিটিয়ে মেরেছে।”
নিহতদের মধ্যে ফারুক এবং শান্তর শরীরে গুলির ক্ষত ছিল বলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দিন জানিয়েছেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি, ছাত্রলীগ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে ও গুলি চালায়। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, আন্দোলনকারীদের মধ্যে বহিরাগত ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়, তারাই গুলি চালিয়েছে।