শনিবার বিকালে পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকায় পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন তারা। তাদের দাবির প্রতি একাত্মতা জানিয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতারা।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ‘জরিপ অনুযায়ী’ বন্দর এলাকার লালদিয়ার চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আদালতের নির্দেশনা দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, হাই কোর্টের আদেশ অনুসারে সহসাই অবৈধ দখলদারদের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ করা হবে।
সব ‘অবৈধ দখলদারদের’ অবিলম্বে ওই জায়গা ছেড়ে দেওয়ারও অনুরোধ করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
বিকেলে কর্মসূচিতে লালদিয়ার চর উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলমগীর হাসান বলেন, “এখানকার ২৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার বাসিন্দা পুনর্বাসন চায়। বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদ না করে আগে আমাদের পুনর্বাসন করা হোক।
“উচ্চ আদালতের নির্দেশ আমাদের জন্য নয়, যারা নদীর ২০ ফুটের মধ্যে দখলকারী তাদের জন্য। আদেশের সুযোগে বন্দর চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। আমরা নদী থেকে ৫০০ ফুট দূরে বসবাস করি। ২০১৯ সালে জেটি করবে বলে ২০ একর ভূমি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করা হয়। এখন বাকিটাও উচ্ছেদের আয়োজন করা হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই জমি ইজারা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।”
নগর আওয়ামী লীগ নেতা রোটারিয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, “১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমান বাহিনীর ঘাঁটি সম্প্রসারণের প্রকল্প নিলে তখন লালদিয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা নিজেদের পৈত্রিক বসতভিটা ছেড়ে এখানে এসেছিল। তারা এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।
“মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ের খোঁজে আসা রোহিঙ্গাদেরও ঠাঁই দিয়েছেন। এই উচ্ছেদে হতভাগ্য ১৪ হাজার মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা হোক।”
কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন, নারী কাউন্সিলর শাহানুর বেগম, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর প্রমুখ।
শনিবার ১২ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে বিজয় নগর পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধনে হাজার খানেক বাসিন্দা অংশ নেন।
সি ব্লক এলাকায় মানববন্ধনকারীদের পাশে ফুটপাতে ক্র্যাচ নিয়ে বসে থাকা দিদারুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পায়ের সমস্যার কারণে আমি ব্যাটারি রিকশা চালাই। আর কিছু করতে পারি না। এখানে ২০ বছর ধরে থাকি। তুলে দিলে কোথায় যাব?”
আবদুস শুক্কুর নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেন, “৪৯ বছর ধরে আছি। এই ঠিকানায় ভোটার। বাড়িঘর সব এখানে। পরশু রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই। উচ্ছেদ করলে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সরকারের জমি লাগলে নিবে। কিন্তু আমাদের আগে ঘর দিক।”
পাঁচ দশকের বসতি
লালদিয়ার চরে বসতি শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সে সময় বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয়দের তুলে দেওয়া হলে তারা ঠাঁই নেন লালদিয়ার চরে।
১৩৮০ বাংলা সনে (১৯৭৩-১৯৭৪ সালে) জেলা প্রশাসন এখানকার বাসিন্দাদের এক সনা বন্দোবস্ত দেন।
সে সময় এখানে লালদিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মিত হয়। ১৯৭৪ সালে জলোচ্ছ্বাস থেকে চর রক্ষায় সরকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে।
“জিয়া ও এরশাদ সরকারের সময়ে এই জমি বিএস জরিপে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নামে লিপিবদ্ধ করা হয়। এর ভিত্তিতে বন্দর আমাদের বেআইনি দখলদার বলে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র শুরু করে।”
২০০৫ সালের ১২ জুলাই প্রথমবার লালদিয়ার চরের ৫০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। ওই অংশে একটি বেসরকারি অফডককে বন্দর ইজারা দেয় বলে জানান আলমগীর।
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জেলা প্রশাসন আমাদের বন্দবস্ত দিয়েছিল। অথচ তাদের কাছেও আমরা আজ দখলদার।
“আমরা জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী-সাংসদ, জেলা প্রশাসক, সাবেক ও বর্তমান মেয়র সবার সাথে যোগাযোগ করেছি। সবাই আমাদের বিষয়টি জানেন। আমরা মানবিক সমাধান চাই।”
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ২৫০ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় ২০ একর জমি দখলমুক্ত করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
সেই জরিপে নদীর দুই তীরে প্রায় আড়াই হাজার অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন। প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়।
এরপর ২০১৬ সালের ১৬ অগাস্ট হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দেয়।