লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ শুরু, পুনর্বাসনের দাবি

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।সোমবার সকাল থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়, চলে বিকাল পর্যন্ত।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2019, 03:05 PM
Updated : 22 July 2019, 03:06 PM

উচ্ছেদের শিকার লালদিয়ার চরের বাসিন্দারা সরকারের কাছে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছে।

বন্দর কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭২ সালে যারা লালদিয়ার চরে বন্দোবস্তি পেয়েছিলেন তাদের পরবর্তীতে পুনর্বাসন করা হবে। তবে কোনো অবৈধ বসতি স্থাপনকারী পুনর্বাসনের আওতায় থাকবে না।

কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত ১২ ও ১৩ নম্বর খালের মধ্যবর্তী অংশে সোমবার উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়। চরের এই অংশে প্রায় আড়াইশ স্থাপনা প্রথম ধাপে উচ্ছেদ করা হবে।

সোমবার সকালে লালদিয়ার চরে গিয়ে দেখা যায়, চরের জমিতে গড়ে ওঠা স্থাপনা ভাঙার কাজ চলছে।

ছয়টি লং বুম স্কেভেটর ও চারটি পে লোডার নিয়ে ৬০ জন শ্রমিক স্থাপনার ভাঙার কাজ করছিল। নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন ছিল প্রায় একশ পুলিশ ও আনসার সদস্য।

১২ নম্বর ঘাটের অদূরে ইটের রাস্তার লাগোয়া একটি একতলা নতুন ভবন ভাঙার কাজ চলছিল। ভবনটির মালিক আনোয়ার হোসেন এসময় ছোটাছুটি করে জিনিসপত্র বের করার চেষ্টা করছিলেন।

আনোয়ার হোসেন বলেন, “দুই লাখ টাকা গণ্ডা দরে চার গণ্ডা জমি মোট আট লাখ টাকায় কিনেছি। এরপর বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ফাউন্ডেশন (ভিত্তি) দিয়ে একতলার কাজ শেষ করি।”

কার কাছ থেকে জমি কিনেছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি আনোয়ার।

বেড়িবাঁধের উপর ঘরের জিনিসপত্র রেখে হাত পা ছড়িয়ে বসেছিলেন জেলে পরিবারের সদস্য পূর্ণিমা জলদাস।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক লাখ টাকায় এক গণ্ডা জমি কিনেছি। অনেক কষ্টে বছর খানেক আগে ঘর করি। একটা নোটিসও দেয়নি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোথায় যাব?”

এক বছরের নাতনিকে কোলে নিয়ে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন দুলাল জলদাস।

তিনি বলেন, “৯১’র ঘূর্ণিঝড়ের পর এখানে এসে উঠি। পরে জমি কিনি। মাছ ধরে সংসার চালাই। জেলে বলে কেউ ঘর ভাড়াও দিতে চায় না। এখন বাঁধের উপরই থাকতে হবে।”

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে পরিবারের শিশুদের বাঁধের ওপর রেখে অন্য সদস্যরা ঘরের টিনসহ অন্যান্য জিনিস বাঁধের ওপর রাখছিলেন।

ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে নিবারণ চন্দ্র জলদাস বলেন, “দুই ছেলে আর আমি, তিন পরিবারে ১৪ জন মানুষ। তিনটা ঘর করতে আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তিনজনই মাছ ধরি।

“জেলেদের তো কেউ ঘর ভাড়া দেয় না। কোথায় যাব?”

লালদিয়ার চরের এই অংশে ৩০টি জেলে পরিবার থাকে।

জেলে পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, বাঁধ লাগোয়া অংশে তাদের ঘর উচ্ছেদ হবে এটা আগে থেকে সবাই জানত। তবুও তাদের এতদিন চরের ভিতরের অংশে জমি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘর-বাড়ি নির্মাণে অভয় দেয় উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতারা।

জেলে পাড়া পেরিয়ে এগিয়ে গেলে বাঁধের লাগোয়া অংশে একটি লম্বা মেসবাড়ি ভাঙার কাজ চলছিল। বাঁধে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মেসবাড়ির মালিক মো. হারুন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাত্র এক বছর আগে মাটি ভরাট করে ঘর করেছি। এখানে গরিব মানুষ মেস করে থাকত।

“রোহিঙ্গারও এদেশে থাকতে পারে। নদীর জায়গায় আমরা থাকতে চাই না। কিন্তু আমাদের তো সরকার কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে পারতো।”

উচ্ছেদের শিকার চরের বাসিন্দাদের দাবি, উচ্ছেদ করা হবে না এবং নতুন করে চরের পিছনের অংশে ঠাঁই দেয়া হবে এমন আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন সময় লালদিয়ার চর উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতারা মোটা অংকের চাঁদা তুলেছেন।

বন্দোবস্তী-দখল-বিক্রি, পুনর্বাসনের দাবি

লালদিয়ার চরে বসতি শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সেসময় বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয়দের তুলে দেওয়া হলে তারা ঠাঁই নেন লালদিয়ার চরে।

পরে চরের খালি জমিতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল নেয়। সেসব জমি কয়েক হাত বদল হয়ে বাড়তে থাকে দাম।

ন্যূনতম ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা গণ্ডায় এসব জমির দখলি স্বত্ব বিক্রি হয় বিভিন্ন সময়। বাড়তে থাকে বসতির সংখ্যা।

লালদিয়ার চর উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলমগীর হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু আমাদের অস্থায়ী বন্দোবস্তী দেন। ১৯৭৪ সালে বেড়িবাঁধও নির্মাণ করে দেন।”

“১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেড়িবাঁধটি সংস্কার করেন। এখন হাই কোর্টের নির্দেশের কথা বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের উচ্ছেদ করছে। ১১ জুলাই তারা এসে লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়।”

আলমগীর বলেন, “আরএস জরিপ অনুসারে বাঁধের সামনের পাঁচশ ফুট অংশে উচ্ছেদ করা হবে বলে জানিয়েছে। জেলে পরিবারের সদস্যদের চরের পিছনের অংশে খালি জমিতে থাকার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করব।”

টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থা এমপি-মেয়র-মন্ত্রী সবাই জানেন। উনারা মাথা ঘামিয়ে কিছু করতে পারেনি। আমরা কী করব? যাদের ঘর গেছে তাদের মন ভালো নেই, তাই বলেছে।

“গরিব মানুষের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ব্যবস্থা করুক, সেটাই চাই।”

ধাপে ধাপে চলবে উচ্ছেদ

উচ্ছেদ অভিযানে থাকা বন্দরের আইন কর্মকর্তা যুগ্ম জেলা জজ মুনতাসির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুসারে সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়ে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

“যেহেতু আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ তাই নোটিস দেওয়ার সুযোগ নেই। ১৫ দিন আগে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উচ্ছেদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২৫০ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এটা কেবল শুরু। এরপরও চলবে।”

বন্দরের এস্টেট বিভাগের প্রধান জিল্লুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশিরভাগ স্থাপনাই আজ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনার অবশিষ্ট অংশ কয়েকদিনে সরিয়ে নেয়া হবে। প্রথম ধাপে ২৫ একর জমি দখলমুক্ত করা হবে। লালদিয়ার চরের মোট ৫২ একর জমি ধাপে ধাপে দখলমুক্ত করা হবে।”

বন্দরের পর্ষদ সদস্য (প্রকৌশল) কমডোর খন্দকার আখতার হোসেন বলেন, বাঁধ সংলগ্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেটি নির্মাণ করা হবে।

“১৯৭২ সালে যারা বন্দোবস্তী পেয়েছিলেন তাদের হামিদের চরে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা আছে। জমিও নির্ধারণ করা আছে। তবে কোনো অবৈধ বসতি স্থাপনকারীকে পুনর্বাসন করা হবে না।”