দাপট দেখিয়েই চট্টগ্রামের ওই ব্যবসায়ীকে বশ করেন সাহেদ

ঢাকায় অটোরিকশার রুট পারমিট করে দেওয়ার কথা বলে চট্টগ্রামের যে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রিজেন্ট চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ৯১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে তাকে নিজের ‘ক্ষমতার’ দাপট দেখিয়েছিলেন তিনি।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2020, 05:38 PM
Updated : 14 July 2020, 06:29 PM

জিয়াউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের প্রতিষ্ঠান ‘মেগা মোটরস’র কয়েকটি সিএনজি অটোরিকশার বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ২০১৬ সালে আটক করেছিল পুলিশ। বাকিগুলো ছেড়ে দিলে একটি অটোরিকশা আটকে রাখার পর সেটি ছাড়াতে চট্টগ্রামে যান সাহেদ।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই সফরে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বড় বড় কর্তাদের কাছে যান তিনি। ছাড়িয়ে আনেন অটোরিকশাটি। যে পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অটোরিকশা আটক করেছিলেন তাদের হুমকি-ধমকি দেন। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের সিকিউরিটি সেলে অভিযোগও করান বলে ওই পুলিশ সদস্যদের সন্দেহ।

ওই ঘটনার পর পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক একটি জিডি করেছিলেন। তবে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ হওয়ার পর ওই দলের দুই পুলিশ সদস্যের লঘু দণ্ড হয়, বাকি দুজনের বিরুদ্ধে এখনও তদন্ত চলছে বলে তারা জানিয়েছেন।

যে ‘মেগামোটরস’র অটোরিকশা ছাড় করাতে সাহেদ চট্টগ্রামে এসেছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানই সোমবার তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে ৯১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছে।

এই মামলার বাদী ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরের চাচাত ভাই মো. সাইফুদ্দিন এখন বলছেন, ওই অটোরিকশাটি ছাড় করানো ছিল সাহেদের ‘টোপ’। এরপর তিনি ঢাকায় দুইশ অটোরিকশা চলাচলের জন্য অনুমতি নিয়ে দেওয়ার কথা বলে ৯১ লাখ টাকা নিয়ে নেন।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেগা মোটরসের ঢাকা অফিসের কর্মচারী শহীদুল্লার ভাতিজির সঙ্গে সাহেদের চাচাত ভাইয়ের বিয়ে হয়। ওই বিয়েতে সাহেদের সাথে মেগা মোটরসের মালিক জিয়াউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও তার চাচাত ভাই সাইফুদ্দিনের পরিচয়।

এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগরে মেগা মোটরসের গোডাউনে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।

এ সময় ওই গুদামে থাকা ১৭টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারায় সেগুলো জব্দ করে এবং মেগা মোটরসের মালিক জিয়াউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও ম্যানেজার জাহেদকে আটক করে পুলিশ। ওই দিনই একজন আইনজীবীর জিম্মায় বিক্রি না করার মৌখিক শর্ত দিয়ে ১৬টি অটোরিকশা ও আটক দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের সে সময়ের এসআই আফতাব হোসেন জব্দ অটোরিকশায় মূল চেসিস নম্বর ও ইঞ্জিন নম্বর ছাড়াও নতুনভাবে ওয়েল্ডিং করে লাগানো চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বরের বিষয়ে জানতে বিআরটিএতে আবেদন করেন ওই বছরের ৭ নভেম্বর।

এর মধ্যে ২৯ ডিসেম্বর গাড়িগুলো বিক্রির অনুমতি চেয়ে পুলিশের কাছে লিখিত আবেদন করেন মেগা মোটরসের মালিক জিয়াউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।

২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি বিআরটিএ পুলিশকে চিঠি দিয়ে জানায়, ওই গাড়ির কোনো রেজিস্ট্রেশন তারা দেয়নি এবং অটোরিকশার বডিতে ও প্লেটে একটিই চেসিস নম্বর থাকে, দুটি নয়। ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি বিআরটিএ’র পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি পরিদর্শন শেষে দুই চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বরের ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা তদন্তে ফরেনসিক পরীক্ষার সুপারিশ করে।

এরপর দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে মোহাম্মদ সাহেদের।

সাহেদের বিরুদ্ধে মামলার বাদী মো. সাইফুদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৫ সালের শেষের দিকে আমরা ভারত থেকে কিছু সিএনজি আনি। এগুলো নিয়ে পুলিশের সাথে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়। কেউ তাদের বলেছিল, সেগুলো এখানে তৈরি। পরে সেগুলো পুলিশ নিয়ে আসে। ১৭টার মধ্যে পরে রাতেই ১৬টা তারা নিজেরে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দেয়। একটা পুলিশের কাছে ছিল।

“সে বিষয়ে সাহেদ কথা বলেছিল, মনে হচ্ছে সেটা তার সাজানো। চট্টগ্রামে এসে সাহেদ পুলিশের আটকে রাখা সিএনজিটি ছড়িয়ে নিতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে গিয়েছিল আমার ভাইকে (জিয়াউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর) নিয়ে। ওই দিন সে আমার ভাইকে নিয়ে আরও কয়েক জায়গায় গিয়েছিল।”

২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কার্যালয়ে জিয়াউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে সঙ্গে নিয়ে আসেন সাহেদ। সেখানে তিনি কয়েকজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন।

পরে অভিযানকারী দলের দুই সদস্য সে সময়ের এসআই আফতাব হোসেন ও রাজেশ বড়ুয়াকে (বর্তমানে দুজনই কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক) হুমকি দেন।

ওই ঘটনার বিষয়ে আফতাব হোসেনের করা একটি জিডিতে বলা হয়, “সাহেদ বলেন, আমি ফোন করার পরও কেন অটোরিকশা ছাড়া হয় নাই, আমাকে কেন চট্টগ্রামে আসতে হল?”

“আফতাব হোসেন ও রাজেশ বড়ুয়ার উদ্দেশ্যে সাহেদ বলেন, আমার হাত মন্ত্রী, সচিব ও বাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসার পর্যন্ত। আমার কথা শুনতে সবাই বাধ্য। মেগা মোটরসরসহ দেশের অনেককে এ রকম অটোরিকশা আনতে সহায়তা করি ও বিআরটিএর মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করে দিই।

“ঢাকায় গিয়ে উর্ধ্বতন অফিসারদের বলব যেন তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

এর পরপর ঢাকায় পুলিশের সিকিউরিটি সেলে নাম গোপন রেখে এক ব্যক্তি আফতাব ও রাজেসসহ অভিযানকারী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

সে সময়ের সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) বর্তমানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্যের কাছে ওই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই অটোরিকশাগুলো নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা ছিল। তারা বলেছিল, সেগুলো ভারত থেকে আমদানি করা। আবার বিআরটিএ বলেছিল তারা রেজিস্ট্রেশন দেয়নি।

“সাহেদ করিম তখন আমার কাছে তদবির করতে আসেনি। সরাসরি কোনো তদবির করেনি।”

ওই ঘটনার বিষয়ে পুলিশ পরিদর্শক আফতাব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনুমোদনবিহীন অটোরিকশা গুদামে আছে সে তথ্যে আমরা সেখানে অভিযানে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাহেদ করিম মেগা মটরসের পক্ষ নিয়ে আমাদের হুমকি দিয়েছে। আমাদের অভিযান দলের বিরুদ্ধে অভিযোগও দাখিল করিয়েছে। তাতে দুই এএসআই আজমীর শরীফ ও সাদেকের ইতোমধ্যে লঘু দণ্ড হয়েছে। আমি এবং আমার সহকর্মী রাজেস বড়ুয়ার বিরুদ্ধে এখনও তদন্ত চলছে।”

সিএনজিগুলো বৈধ, মেগা মোটরসের এমন দাবির বিষয়ে আফতাব হোসেন বলেন, “জব্দ একটি অটোরিকশা যাচাই শেষে বিআরটিএ বলেছে সেটা তাদের সার্কেল থেকে নিবন্ধিত নয়। তাদের বিশেষজ্ঞ দল সিএনজিটির ফরেনসিক টেস্টের পরামর্শও দিয়েছিল। কিন্তু তার আগে মোহাম্মদ সাহেদ চাপ প্রয়োগ করে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।”

আটক ১৭টি অটোরিকশা ছাড়াতে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ ছাড়াও বিভিন্ন সময় চট্টগ্রামের কয়েকজন রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন ব্যক্তি সুপারিশ করেছিলেন বলে স্বীকার করেন সাইফুদ্দিন।

এ ঘটনায় সাহেদের সম্পৃক্ততা নিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অটোরিকশা আটকের খবর পেয়ে সাহেদ নিজে থেকেই চট্টগ্রামে আসে। আমার ভাই (জাহাঙ্গীর) তাকে আসতে বলেনি। সেদিন ভাইকে নিয়ে উর্ধ্বতন বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার কাছে যায় সাহেদ।

“এরপর বলে ওই ১৭টি অটোরিকশাসহ আরও ২০০ অটোরিকশা ঢাকায় চলাচলের রুট পারমিট নিয়ে দেবে। সেটা ছিল তার ফাঁদ। তার কথায় ১৭টি সিএনজি কন্টেইনার ভাড়া করে আমরা ঢাকা পাঠিয়ে দিই।”

সাইফুদ্দিন বলেন, “এরপর কয়েক দফায় ৯১ লাখ টাকা নেওয়ার পর স্মারক নম্বর ছাড়া বিআরটিএ চেয়ারম্যানের নামে একটি পরিপত্র আমার ভাইকে দেয় সাহেদ। পরে চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে জানতে পারি সেটি নকল।

“এরপর টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকি-ধমকি দেয় সাহেদ। ঢাকায় গাড়ি চলাচলের অনুমতি নিয়ে দেবে বলে আরও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।”