প্রতি বছর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে গরু লালন-পালন করেন সারা দেশের কয়েক লাখ মানুষ। এই সময় গরু বিক্রির টাকা থেকেই সারা বছরের খরচ উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের লাভের খাতাটাও কিছুটা ভারি হয়।
ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধের পর পাঁচ বছরে গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। লাভজনক হওয়ায় এতে যোগ দিয়েছে বহু পরিবার। তবে এবার কোরবানির ঈদ সামনে রেখে সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা পাচ্ছেন না তারা। তার বাস্তব কারণও রয়েছে বলেও জানিয়েছেন খামারিরা।
“প্রতিবছর এই সময় থেকেই আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন গরু দেখতে আসে, খোঁজ-খবর নেয়। এবার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ভয়ে আছি খরচ উঠাতে পারব কি না,” বলছিলেন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মিঠানলা এলাকার বাসিন্দা মো. ইউনুস।
ইউনুস মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খাবারের দাম ও গরু দেখাশোনার জন্য রাখা লোকজনের বেতন মিলিয়ে অনেক খরচ। প্রতি বছর কোরবানিতে গরু বিক্রি করেই খরচ উঠানো হয়।”
এবার কোরবানি গতবছরের তুলনায় কম হবে বলে মনে করছেন ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়াজেদিয়া এলাকার হোমল্যান্ড ডেইরি ফার্মের মালিক মো. ওমর।
এই ধারণার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে।”
তার কথার সমর্থন মেলে পটিয়া উপজেলার জোলার দিঘিরপাড় এলাকার ওয়াহিদ ডেইরি ফার্মের মালিক আনিস আহম্মদের কথায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোর বেশিরভাগই একটি বা একাধিক গরু কোরবানি দেয়।
“কিন্তু এবার কয়েক পরিবার মিলে একটি গরু কোরবানি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। ফলে চাহিদা কমতে পারে। যেহেতু পর্যাপ্ত গরু আছে তাই চাহিদা কমলে দাম কমে যেতে পারে, এই ভয় আছেই।”
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণ খামারি বা ঘরে যারা গরু পালন করে তারা একবার কম দাম পেলে এর প্রভাব পড়ে পরের বারে। পরের বছরের জন্য গরু-ছাগল প্রস্তুত করতে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।”
চট্টগ্রমের পটিয়া, চন্দনাইশ, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া, রাউজান, হাটহাজারী এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় খামার ও গৃহস্থদের পালন করা গরু কোরবানির বাজারে আসে।
চট্টগ্রামের কোরবানির হাটগুলোতে শঙ্কর জাতের গরুর চেয়ে দেশি জাতের গরুর চাহিদা বেশি থাকে। পাশাপাশি রেড চিটাগাং এবং সম্প্রতি ব্রাহামা জাতের গরুরও চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাজারে তিন মণ ওজনের শঙ্কর জাতের গরু ৬০-৬৫ হাজার টাকায় এবং একই ওজনের দেশি জাতের গরু ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সামাজিক অনুষ্ঠান, মেজবান, ওরসের মতো অনুষ্ঠান কম হওয়ায় গত তিন মাসে গরু বিক্রিও কমে গেছে।
বর্তমানে চট্টগ্রামে যে সংখ্যক গরু, ছাগল ও মহিষ আছে, তা কোরবানির চাহিদা পূরণের কাছাকাছি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক।
এসব পশুর মধ্যে গরু চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭২টি, মহিষ ৫৭ হাজার ১৩১টি, ছাগল ও ভেড়া এক লাখ ৬৭ হাজার ২১০টি।
রেয়াজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অবশিষ্ট ৪১ হাজারের মতো গরু যশোর, সিরাজগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি জেলা থেকে আসলেই গরুর চাহিদা পূরণ হবে।
“তবে এবার পরিস্থিতির কারণে (করোনাভাইরাস সংক্রমণ) বাইরের জেলাগুলো থেকে গরু কম আসবে। চট্টগ্রামের চাহিদা এখানকার গরু-ছাগল দিয়েই মেটানো সম্ভব হবে। তাই দাম বাড়বেও না, কমবেও না।”
এখানেই আশাবাদী হয়ে উঠছেন খামার মালিক মো. ওমর।
“চট্টগ্রামে যদি বাইরে থেকে বেশি গরু না ঢোকে তাহলে কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যেতে পারে,” বলেন তিনি।
পাঁচ বছরে গরু-ছাগল দ্বিগুণ
কোরবানি উপলক্ষে গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম জেলায় স্থানীয়ভাবে পশুর উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
ভারত থেকে গরু আমদানি কমে যাওয়ায় ২০১৪-১৫ সাল থেকেই চট্টগ্রামে গরুর খামার ও গরু লালন-পালন বেড়ে যায়।
এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই চট্টগ্রামে কোরবানি উপলক্ষে গরু-মহিষ-ছাগলের উৎপাদন বেড়েছে।
২০১৫ সালে স্থানীয়ভাবে পশুর উৎপাদন ছিল তিন লাখ ২০ হাজার। সে বছর চার লাখ ৯২ হাজার ২৫০টি পশু জবাই হয়েছিল। প্রতি বছর বেড়ে সেখানে ২০১৯ সালে জেলায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা পশুর সংখ্যা বেড়ে হয় ছয় লাখ ১০ হাজার, যা ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
খামার মালিক ওমর বলেন, “স্থানীয় বাজারে চাহিদা থাকায় গরুর খামার অনেক বেড়েছে। কিন্তু খাবারের দাম অনেক বেশি। পাশাপাশি ডেইরি শিল্পখাতে সরকারি ভর্তুকি তেমন পাওয়া যায় না।
“এ কারণে চলতি বছরের কোরবানির বাজারে কেমন দাম পাওয়া যায়, তার উপর পরের বছর কয়টা গরু লালন-পালন করবেন তা ঠিক করেন খামারিরা। উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।”