অর্ধেক শয্যা খালি, তবু রোগী ফেরাচ্ছে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও সাধারণ রোগীদের ফিরিয়ে দেয়ার একের পর এক অভিযোগ উঠছে, তখন চট্টগ্রাম জেলার ২০টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে মোট ৮২৫ শয্যা খালি, যা এসব প্রতিষ্ঠানের মোট ধারণক্ষমতার প্রায় অর্ধেক।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2020, 11:18 AM
Updated : 10 June 2020, 12:03 PM

আর আইসিইউ শয্যার খোঁজে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও এসব ক্লিনিকের আইসিইউতে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ২৫ জন, যা সক্ষমতার চার ভাগের এক ভাগ। 

সবশেষ মঙ্গলবার চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের এক নেতা বুক ব্যথা নিয়ে কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি। এক পর্যায়ে গাড়িতেই মারা যান শফিউল আলম ছগীর নমের ওই নেতা।

বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ৫৭ বছর বয়সী শফিউলের পরিবারের বরাত দিয়ে নেতারা জানিয়েছেন, প্রথমে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হলেও সেখানে চিকিৎসার পরিবেশ না থাকায় মেডিকেল সেন্টার নামে সগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউ বন্ধ ও চিকিৎসক না থাকার অজুহাতে রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

এরপর তাকে জিইসি মোড় সংলগ্ন মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকেও ফিরিয়ে দেয়া হলে সেখান থেকে পাঁচলাইশের পার্কভিউ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও প্রথমে ভর্তি নিতে না চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের হস্তক্ষেপে ভর্তির প্রক্রিয়া চলার মধ্যে গাড়িতেই মারা যান ছগীর।

এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দিতে অনাগ্রহী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে সার্ভেইল্যান্স টিম।

এজন্য বুধবার তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিনটি দল গঠন করা হয়েছে।

দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি অন্যন্যি রোগীদেরও আলাদা ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। 

তবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকরা বলছেন, চিকিৎসক স্বল্পতা ও আইসিইউ বেড নষ্ট থাকাসহ নানা কারণে তারা সক্ষমতা অনুসারে রোগী ভর্তি করাতে পারছেন না।

কোথায় কত শয্যা খালি

এর আগে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মনিটর করতে গঠিত সার্ভেইল্যান্স দল ৩ জুন হাসপাতালগুলোর তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়।

সার্ভেইল্যান্স টিমের কাছে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই দেখা যাচ্ছে, নগরী ও জেলার ২০টি হাসপাতালে মোট ১৫৮৮টি শয্যার মধ্যে ৮২৫টি খালি ছিল মঙ্গলবার।

এর মধ্যে চন্দনাইশ উপজেলায় বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩০০ শয্যার মধ্যে ২৮৫টিই খালি ছিল। সেখানে একটি ১০০ শয্যার কোভিড-১৯ স্থাপনের কাজ চলছে।

নগরীর মধ্যে পূর্ব নাসিরাবাদ চন্দ্রনগর মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৫০ শয্যার মধ্যে ২১৩টিই খালি আছে। বহদ্দারহাটের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৫০ শয্যার মধ্যে ১১৯টি খালি।

ওআর নিজাম রোডের মেডিকেল সেন্টারে ১২৪ শয্যার মধ্যে ৬১টি শয্যাই খালি। সিএসসিআর এ ৮০ শয্যার মধ্যে ৩৯টি খালি।

পাশাপাশি ইম্পেরিয়াল ও শেভরন হাসপাতালে ৩০টি, সার্জিস্কোপে ১৫ এবং রয়েল হাসপাতালে ১৩টি শয্যা খালি। এছাড়া এশিয়ান হাসপাতালে ৮টি, পার্কভিউ ও সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬টি করে বেড খালি আছে বলে জানা গেছে।

২৩০ শয্যার চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে মঙ্গলবার একটি শয্যাও খালি নেই। এখানকার কোভিড-১৯ ইউনিটে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১১ জন এবং কোভিড-১৯ সাসপেক্ট ৫০ জন রোগী ভর্তি আছেন।

ম্যাক্স হাসপাতালের ৮০টি শয্যার সবগুলোতেই রোগী আছেন। মেট্রোপলিটন ও ডেল্টা হাসপাতালে ৭০টি করে শয্যার একটিও ফাঁকা নেই।

সার্ভেইল্যান্স টিমের আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোগীদের চিকিৎসা ছাড়া যাতে ফিরিয়ে দেয়া না হয় সে বিষয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের বহুবার বলেছি। তাদের কেউ কেউ সেটা শুনছেন না।

“এখন আমরা ব্যবস্থা নেব। তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিনটি টিম গঠন করা হয়েছে। আজ থেকেই মনিটরিং অভিযান শুরু হতে পারে। তারা যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলোর সত্যতাও যাচাই করা হবে। রোগীদের চিকিৎসা না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

এর আগে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের আহমদ কায়কাউসের উপস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের সাথে চট্টগ্রামের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ভিডিও কনফারেন্সে এক সভা করেন।

মো. মিজানুর রহমান বলেন, “মুখ্য সচিব মহোদয় সভায় কড়া ভাষায় তাদের সমালোচনা করেছেন এবং গাফিলতি দেখলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।”

সার্ভেইল্যান্স টিমের সদস্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদিউল আলম বলেন, “সেবা না পাওয়ার যেসব অভিযোগ আপনারা পাচ্ছেন তাতে সত্যতা আছে। এতদিন সর্তক করে, বুঝিয়ে, যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নিয়েছি। চেষ্টা করেছি কেউ যাতে প্যানিকড না হয়।

“বুঝিয়ে না হলে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিষয়টি এখন সেদিকেই যাচ্ছে।”

শয্যা খালি থাকার বিষয়ে বেসরকারি ক্লিনিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খান বলেন, “এরমধ্যে কোনোটা হয়ত লেবার সিট, কোনোটা সিসিইউ, কোনোটা সাধারণ আর কিছু আইসিইউ।

“আলাদা আলাদাভাবে শয্যার হিসেব দিলে বোঝা যাবে কত শয্যা খালি আছে। কোনো হাসপাতালে কোন ধরনের কত শয্যা আছে এবং কত খালি তা লিখে ক্লিনিকগুলোর সামনে টাঙিয়ে দিতে বলেছি, যাতে রোগী ও তাদের স্বজনরা দেখতে পারেন।”

মাত্র ২৫ আইসিইউ সক্রিয়

বেসরকারি ২০ হাসপাতাল ও ক্লিনিক যে হিসাব দিয়েছে সে অনুসারে, তাদের মাত্র পাঁচটি হাসপাতালের ২৫টি আইসিইউ শয্যায় রোগী আছে।

এর মধ্যে পার্কভিউ হাসপাতালে আটটি, ম্যাক্স হাসপাতালে ছয়টি, ন্যাশনাল ও সার্জিস্কোপে চারটি করে এবং সিএসটিসি হাসপাতালে তিনটি আইসিইউ বেডে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন।

এ বিষয়ে ডা. লিয়াকত আলী খান বলেন, “আমাদের (বেসরকারি) মোট একশটির মত আইইসিইউ ছিল। এরমধ্যে ৫০-৬০টির মত এখন চালু আছে। যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ায় কিছু আইসিইউ চালানো যাচ্ছে না।

“আবার তার মধ্যেও তিন-চারটি হাসাতালে আইসিইউ চালানোর মত চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল না থাকায় তারা রোগী ভর্তি বন্ধ রেখেছে।”

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদিউল আলম বলেন, আইসিইউ বিষয়ে বেসরকারি ক্লিনিক মালিকরা যে তথ্য দিচ্ছেন তা সঠিক কিনা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মার্চে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফল ‘নেগেটিভ’ না হলে সাধারণ রোগীদেরও সেবা দিতে অনীহার অভিযোগ আসছিল।

একাধিক হাসপাতালে ঘুরে সেবা না পেয়ে রোগী মৃত্যুর অভিযোগও ওঠে বেশ কয়েকটি। সরকারি নির্দেশনার পরও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা চালু করাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।

এরমধ্যে গত কয়েকদিনে বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতাল এবং ইউএসটিসির বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালু হয়েছে।