ফাঁসির দিনে মাস্টারদা সূর্যসেনকে স্মরণ-শ্রদ্ধা

ব্রিটিশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের নেতা বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসি দিবসে বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2020, 03:54 PM
Updated : 12 Jan 2020, 03:56 PM

৮৬ বছর আগে মাস্টারদা সূর্যসেনকে নির্যাতন ও ফাঁসি দেওয়ার দিনটিকে স্মরণ করে শনিবার একাধিক সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

নগরীর জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে স্থাপিত সূর্যসেনের আবক্ষ মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, চট্টগ্রাম বিপ্লব ও বিপ্লবী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, চিটাগং অ্যাসোসিয়েশন, পথিকৃৎ পাঠাগার, সূর্যসেন স্মৃতি পাঠাগার, শহীদ আসাদ স্মৃতি সংসদ চট্টগ্রাম ও শহীদ অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর স্মৃতি পরিষদ।

পরে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি রিপায়ন বড়ুয়া বলেন, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে চার দিন চট্টগ্রামকে ব্রিটিশমুক্ত করে রেখেছিলেন।

“এখনও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত জালালাবাদ পাহাড়ে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। যুব বিদ্রোহের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।”

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক উজ্জল শিকদার বলেন, “তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সোনালী অতীত এখনও অজানা। সব স্তরের পাঠ্যপুস্তকে এই ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

“ইতিহাস রক্ষা এবং মাস্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তসহ বিপ্লবের মহানায়কদের স্মরণে বন্দর নগরীর প্রধান সড়কগুলোর নামকরণের দাবি জানাই।”

বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সিঞ্চন ভৌমিক বলেন, “সরকারিভাবে বিপ্লবীদের কোনো দিবস পালন করা হয় না। তাই এই প্রজন্ম চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে।

“চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে একই দিনে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারকেও ফাঁসি দেওয়া হয়। আমরা ফাঁসির মঞ্চে তারকেশ্বরের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানাই।”

পাশাপাশি সংগঠনটির পক্ষ থেকে নয় দফা দাবি জানানো হয়।

এর মধ্যে আছে- বিপ্লবীদের নাম সরকারিভাবে গেজেট আকারে প্রকাশ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সব নেতাকর্মীদের স্মৃতি সংরক্ষণ, ১২ জানুয়ারিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলকে যুব বিদ্রোহ দিবস ঘোষণা, পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাবকে বীরকন্যা প্রীতিলতা জাদুঘর ঘোষণা, ফাঁসির মঞ্চে তারকেশ্বরের ম্যুরাল ও নাম সংযোজন, বিপ্লবীদের বাড়ি-জমি উদ্ধার ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীতে বিপ্লবী পরিবারদের সম্মাননা প্রদান।

এর আগে কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত সমাবেশে জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, “সূর্যসেনরা যে স্বাধীনতা ও সাম্যের জন্য লড়াই করেছিল, আজও বাংলাদেশের মানুষকে সেই লড়াই করতে হচ্ছে বাক স্বাধীনতার জন্য, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য, গণতান্ত্রিক ও শোষণ বৈষম্যহীন সমাজের জন্য।

“মানবিক পৃথিবী বিনির্মাণের মাধ্যমেই মাস্টারদার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।”

এ সময় সিপিবি নেতা ফরিদুল ইসলাম, অমিতাভ সেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিপ্লব ও বিপ্লবী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক আলমগীর সবুজ বলেন, “চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি মঞ্চে সম্মাননা জানানোর অনুমতি চেয়েও জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

“বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। চট্টগ্রামে মাস্টারদার নামে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কের নামকরণে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাই।”

পরিষদের সদস্য সাইদুল ইসলাম, প্রীতম দাশ ও অনুপম শীল প্রমুখ এই স্মরণ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন।

এদিন মাস্টারদা সূর্যসেনের জন্মস্থান রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ায় সূর্যসেনের আবক্ষমূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সংগঠন।  

এরমধ্যে আছে মাস্টারদা সূর্যসেন মেমোরিয়াল পাঠাগার, উপজেলা যুবলীগ, ছাত্রলীগ, রাউজান সরকারি কলেজ, রাউজান উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ, উপজেলা জন্মাষ্টমী পরিষদ, বাংলার মুখ, শিল্পকলা একাডেমি, রাউজান কলেজ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে জন্ম হয় সূর্যসেনের। ১৯২১ সালে কিছু তরুণ চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ‘ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা’ গঠন করে সশস্ত্র এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন সূর্যসেন।

১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে মাস্টারদার নির্দেশে ও অনন্ত সিংহের নেতৃত্বে প্রকাশ্য দিবালোকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কোষাগার লুট করা হয়।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ হয়। নগরীর দামপাড়া এলাকায় তৎকালীন পুলিশ ব্যারাকের অস্ত্রাগার দখল করে নেন বিপ্লবীরা। সেখানেই অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

এরপর চার দিন স্বাধীন ছিল চট্টগ্রাম। পরে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তিন ঘণ্টার সেই যুদ্ধে ৮২ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয় এবং ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, জালালাবাদ যুদ্ধ ও ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া এ বিপ্লবীকে ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক বিশ্বাসঘাতক গ্রামবাসীর সহায়তায় গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশরা।

ওই বছর অগাস্টে সূর্যসেনের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ফাঁসির আগে দুইজনকেই নির্যাতন করার বিবরণ ইতিহাসের বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। সূর্যসেনের মরদেহ বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি অংশে নিমজ্জিত করা হয় বলেও দাবি করা হয়ে থাকে।