জীবন সায়াহ্নে ইউনুছের চাওয়া শুধু ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি

বয়স ও জীবনযুদ্ধে ন্যুব্জ মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ আলীর এখন একটাই চাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সরকারি তালিকায় নিজের নাম দেখা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Feb 2019, 12:46 PM
Updated : 18 Feb 2019, 12:48 PM

যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দেওয়ার পর বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার পশ্চিম ভূতের দিয়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনুছ নদী ভাঙনে ঘর হারিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন।

এরপর চট্টগ্রামে এসে লবণ শ্রমিক, কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করার পর এখন নিরাপত্তাকর্মী।

আশায় ছিলেন এইসব পরিচয় ছাপিয়ে মিলবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি।

জেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শুরু হলে বরিশাল গিয়ে বাছাই কমিটির কাছে সাক্ষাৎকারও দেন তিনি। কিন্তু সর্বশেষ গেজেটেও তার নাম আসেনি বলে জানান ইউনুছ। 

চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামে চলমান একুশে বইমেলায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম’র স্টলে এই মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে ইউনুছ আলী বলেন, “আমি বরিশাল, নাইন সেক্টরের (৯ নম্বর সেক্টর) একজন মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ডার নুর হোসেনের সাথে যুদ্ধ করছি। যুদ্ধের পরে আর্মস জমা দিছি প্রতাবপুর মিলিশিয়া ক্যাম্পে।

“আমরা তিনটা করে অস্ত্র দিই। দুই কাঁধে দুইটা, হাতে একটা। কারণ আমাদের লোকসংখ্যা যত ছিল, তার তিন গুণ অস্ত্র ছিল। আমরা অপারেশন করি, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীরে সারেন্ডার করাইয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সংগ্রহ করছি।”

অস্ত্র সমর্পণের তালিকায় নিজের নাম আর জমা দেওয়া অস্ত্রের নম্বরের তালিকাটাও দেখান বর্ষীয়ান ইউনুছ আলী। এসময় তার চোখ ছলছল করে ওঠে।

হুজ্জাৎ আলী খন্দকারের চার ছেলের মধ্যে তৃতীয় ইউনুছ ১৯৭১ সালে ভূতের দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন, বয়স তখন ২০।

১৯৭১ সালের ৫ মে তিনি চলে যান বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ক্যাম্পে। সেখানেই সাড়ে তিন মাস প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযোদ্ধা নুর হোসেন নুরু ছিলেন তার কোম্পানি কমান্ডার।

বরিশালের জছশ্রী এলাকায় প্রথম সম্মুখ সমরে অংশ নেন ইউনুছ, যুদ্ধ করেন বামরাইলেও।

ইউনুছ বলেন, “গোরকাঠীর চর অপারেশন করি ৮ই ডিসেম্বরে। ১১ ডিসেম্বর উজিরপুর থানায় অপারেশন করি। পাঞ্জাবিরা আত্মসমর্পণ করে।

“যুদ্ধের সময় রাজাকারও মারছি। এখন কী আর সব বলা যায়?”

স্মৃতিকাতর হয়ে ইউনুছ বলে চলেন, “এরপরও ক্যাম্পে ছিলাম। আর্মির বড় ভাইরা ট্রেনিং করাইত। পরে বলল, তোমরা যে যে কাজে ছিলা সেখানে চলি যাও। পরে লাগলে আবার ডাকিবে।

“ওসমানী সাহেবের একটা সার্টিফিকেট দিল, কিছু টাকা দিল। এগুলি নিয়া আমরা বাড়িতে চলি আসি।”

জীবন সংগ্রামের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “নদী ভাঙনে বাড়িঘর সব নিয়ে যায়। বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। নিজে বাঁচার জন্য চট্টগ্রামে চলি আসি। চট্টগ্রামে আসার পরে কোনো কাজকর্ম না পেয়ে ডেইলি লেবার হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করি।

“মাঝিরঘাটে দীর্ঘদিন লবণের মিলে কাজ করি। এরপর কালুরঘাট পেপসি কোম্পানিতে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করতাম। খুব পরিশ্রমের কাজ। তাই চকবাজার দৈনিক লেবারি কাজ শুরু করলাম। কন্সট্রাকশনের কাজ করি দীর্ঘদিন। হেল্পার থেকে মিস্ত্রি হয়ে গেলাম।”

এরপর ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগে অস্থায়ী কর্মীর কাজ নেন ইউনুছ। গত চার বছর ধরে আছেন মেডিকেল কলেজের কান্তা ছাত্রী নিবাসে (ছাত্রী হল) নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে।

ইউনুছ আলী বলেন, “২০১১ সালে কুমিল্লার এক বন্ধু, সেও মুক্তিযোদ্ধা। সে বলল- মুক্তিযোদ্ধার বহুত কিছু হয়। তুই যখন জেনুইন মুক্তিযোদ্ধা, তুই দ্যাশে (গ্রামের বাড়িতে) তাড়াতাড়ি চলি যা। দ্যাশে ছাড়া হবে না। যেভাবে করি হোক তালিকার ভিতর নামটা দিয়া আস।

“খোঁজ নিলাম, নুর হোসেন কমান্ডার এখনও জীবিত আছে। টেলিফোন নম্বর নিয়ে নুরু (নুর হোসেন) ভাইকে ফোন করলাম। নুরু ভাই বলল- ‘হায়রে ইউনুছ তুই আইজো বাঁইচা আছো? আমি তো জানি যে তুই মারা গেছো। এজন্য গেজেটে তোর কোনো নাম দেওয়া হয় নাই’।”

কমান্ডার নুর হোসেনের পরামর্শে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে গিয়ে লিখিত আবেদন করেন ইউনুছ। 

এরপর চট্টগ্রামে এলে দেখা করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রমের সঙ্গে। তিনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার আশ্বাস দেন বলে ইউনুছ জানান।

বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ক্যাম্পে ইউনুছের মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার নুর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধের সময় প্রায় আট মাস সে আমার সাথে ছিল। ইউনুছ খুব সাহসী যোদ্ধা ছিল।

“চট্টগ্রামে থাকার কারণে তালিকায় তার নাম ওঠেনি। পরে আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখনও গেজেটে নাম ওঠেনি।”

ইউনুছ ‘খুব ভালো ছেলে’ উল্লেখ করে নুর হোসেন বলেন,  “আপনারা একটু দেখেন, যদি তার নামটা ওঠানো যায়।”

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেদারপুর ইউনিয়ন কমান্ডের আহ্বায়ক মো. আবদুর রহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউনুছ আলী ছিলেন সাহসী যোদ্ধা। অনলাইনে আবেদনও করেছিলেন। বাছাই কমিটিতেও সাক্ষাৎকার দিতে আসেন।

“কিন্তু বাছাই কমিটিতে কী হল, এই ভালো যোদ্ধার মতো অনেকে বাদ পড়ে গেল। ইউনুছ আপিল করেছেন। আমরা চেষ্টা করবো তার নাম যেন তালিকাভুক্ত হয়।”

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উচিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশেষ কমিটির মাধ্যমে দ্রুত তদন্ত করে এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।”

চট্টগ্রামেও এমন তিনশ মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাদের নাম তালিকায় নেই বলে জানান এই মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০ বছরের তরুণ ইউনুছ এখন প্রায় ৬৮ বছরের পৌঢ়। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিন মেয়ের জনক ইউনুছ আলী বলেন,  “বয়স হয়ে গেছে। এখন দারোয়ানের কাজ করি। তিন মেয়ের মধ্যে বড় জনের বিয়ে হয়েছে। ছোট দুইজন প্রবর্তক স্কুলে পড়ে। ভর্তির টাকাটাও নিজের কাছে ছিল না। ডাক্তার স্যাররা তুলে দিয়েছে।

“মেডিকেলে অনেকে আমারে মুক্তিযোদ্ধা কইয়া ডাকে। আমি তো যুদ্ধ করছি। কিন্তু তালিকায় নাম নাই।” “যদি আমি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা হই, আমার নামটা যেন গেজেটভুক্ত করেন,” প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আবেদন জানান ইউনুছ।