ভেড়া মার্কেট বস্তিতে সব হারানোর আহাজারি

এক মেয়েকে কোনোমতে বাইরে এনে অন্য সন্তানদের আনতে জ্বলন্ত ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ভেড়া মার্কেট বস্তির রহিমা আক্তার। কয়েক ঘণ্টা পর ওই ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ রহিমার পোড়া লাশ।

মিন্টু চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2019, 09:16 AM
Updated : 17 Feb 2019, 10:02 AM

শনিবার ভোর রাতে চাক্তাইয়ের রাজাখালী খাল সংলগ্ন ওই বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে ২০০ ঘর। জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন তিন পরিবারের আটজন।

ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের ১০টি গাড়ি প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নেভাতে পারলেও ভেড়া মার্কেট বস্তির হাজার খানেক বাসিন্দা সর্বস্ব হারিয়ে এখন হতবিহ্বল। 

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সুরুজ মিয়ার স্ত্রী রহিমা (৫৫) ওই বস্তিতে বসবাস করে আসছিলেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ওই বস্তিরই আরেক ঘরে থাকতে শুরু করেন।

তিন মেয়ে নাজমা আক্তার (১৬), নার্গিস (৯) ও নাসরিন (৫) এবং ছেলে জাকিরকে (১০) নিয়ে বস্তির দুটি ঘরে ছিল রহিমার সংসার। বস্তির পাশে একটি দোকান চালাতেন তিনি।

রহিমার ছোট ভাই পেশায় শ্রমিক মো. আকবরও একই কলোনিতে ভাড়া থাকেন। ভোরের আগুনে ঘর পুড়লেও প্রাণে বেঁচে গেছেন আকবর ও তার স্ত্রী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আকবর বলেন, “আগুন লাগার পর মেজ মেয়ে নার্গিসকে নিয়ে বের হয়ে আসছিল আপা। পরে ছোট মেয়েকে আনতে ভেতরে গেছিল। কিন্তু আর বের হতে পারেনি।”

রাতে ঠিক কী ঘটেছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় রহিমার বেঁচে যাওয়া মেয়ে নার্গিসের কথায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বলে, “ঘুম ভেঙে দেখি আম্মা ঘরের ভেতর ছুটোছুটি করতেছে। পরে আমার ভাই দরজা ভেঙে আমাকে কোনো রকমে বের করে দেয়।

‘‘আম্মাও তখন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু নাসরিনকে আনতে আবার ঘরের ভেতরে ঢোকে। আর বের হতে পারেনি। ডাকাডাকি করেও কোনো আওয়াজ পাইনি।’’

স্থানীয়রা জানান, রহিমার বড় মেয়ে নাজমা ঘরের কাজকর্ম করতেন। আর জাকির স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ত।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রহিমার ঘরের কাঠামো ও জিনিসপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। 

ওই কলোনির বাসিন্দা হোসনে আরা স্থানীয় বিভিন্ন বাসায় বুয়ার কাজ করেন। এক হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় বস্তির একটি ঘরে থাকছিলেন তিনি। 

গভীর রাতে লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভাঙলে হোসনে আরা বুঝতে পারেন, বস্তিতে আগুন লেগেছে। বাইরে এসে দেখতে পান, কলোনির ভেড়া মার্কেট অংশের দিক থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন।

“প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি। ঘর থেকে কিছুই আনতে পারিনি। আগুনে আমাদের সব গেছে। থাকার জায়গাটাও শেষ হয়ে গেছে।”

রহিমার ঘরের কাছেই ছিল স্বামী পরিত্যক্তা আয়েশা আক্তারের (৩৭) ঘর। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর আয়েশা ও তার বোনের ছেলে সোহাগের (১৯) পোড়া লাশ উদ্ধার হলেও তার নিজের মেয়ে ঋতু আক্তারের (১২) কোনো খোঁজ পাননি স্বজনরা।

সোহাগের খালাতো ভাই রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গার্মেন্টে চাকরি করে মেয়েকে মানুষ করার চেষ্টায় ছিলেন তার খালা আয়েশা। আর সোহাগ স্থানীয় একটি চায়ের একটি দোকানে কাজ করতেন।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, মোট আটজনের লাশ তারা উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে একজনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। লাশটি এতটাই পুড়ে গেছে যে নারী না পুরুষ তাও বোঝা যাচ্ছে না।

বাকলিয়া থানাধীন চাক্তাই ভেড়া মার্কেট সংলগ্ন রাজাখালী খালের পাড় এবং কর্ণফুলী নদী তীর সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ সড়কের লাগোয়া জমিতে ওই বস্তিতে ছিল দুই শতাধিক ঘর। 

স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন টিনের ছাউনি আর বেড়ার ছাপড়া দিয়ে এসব ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছিলেন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের কাছে।

এসব ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও পানি বা গ্যাসের সংযোগ ছিল না। কলোনির লোকজনকে ব্যবহার করতে হত গণ-পায়খানা।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন জানিয়েছেন, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।

নিহতদের দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেকের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।