দুই ভাইকে চোখ উপড়ানোর ২৭ বছর পর রায়, সাজা হল মৃত দুজনেরও

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জমির বিরোধ নিয়ে দুই ভাইয়ের চোখ উপড়ে ফেলার ২৭ বছর পর মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে, যাতে সাজাপ্রাপ্তদের দুইজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2018, 02:11 PM
Updated : 26 April 2018, 02:11 PM

১৩ আসামির অপর আরেকজনের মৃত্যুর বিষয়ে আদালত অবহিত থাকায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাকি দণ্ডিতদের মধ্যে দুইজন কারাগারে, অন্যরা পলাতক আছেন।

দীর্ঘ অপেক্ষার এ রায়ে অপরাধীদের সাজার বিষয়টি জানতে পারেননি চোখ হারানো এক ভাই, কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত জজ আদালতের বিচারক স্বপন কুমার সরকার মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের দুইজনকে ১০ বছর এবং ছয়জনকে সাত বছর করে সাজা দেওয়া হয়েছে। খালাস পেয়েছেন চারজন।

২৭ বছর পর পাওয়া এই রায়ে সন্তুষ্ট নন ঘটনার শিকার পরিবারের সদস্যরা। দুই ভাইয়ের চোখ তুলে ফেলার ঘটনায় মামলা করায় তাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহানকেও হত্যা করা হয়েছিল।

ওই পরিবারের দাবি, তাদের জীবন তছনছ করে দেওয়া ওই ঘটনায় জড়িতদের এত দিন পরও ‘যথাযথ শাস্তি হয়নি’।

ভুক্তভোগীদের ভাই ওয়াকিল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৭ বছর ধরে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম। দুই ভাইয়ের চোখ নষ্ট করার ঘটনায় মামলা করে বাবাকে হারাতে হয়েছে।

“বাবার খুনের মামলায় ১২ জনের যাবজ্জীবন হয়েছে। অথচ এই মামলায় মৃতদের সাজা দেওয়া হলো আর জীবিত এজাহারভুক্ত দুই আসামি খালাস পেল।”

মামলায় ১০ বছরের সশ্রম সাজাপ্রাপ্তরা হলেন- আইয়ুব আলী ও মো. ইব্রাহিম। তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক বছরের সাজা দিয়েছে আদালত।

আবদুল হক ছাড়াও সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে সোলায়মান, ইউসুফ, জাফর, দুলা মিয়া ও গোলাম কাদেরের। খালাস পেয়েছেন হাসেম, সালাম, হাশেম ও জাহাঙ্গীর। মারা যাওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন রশিদ আহমদ।

দণ্ডিতদের মধ্যে দুলা মিয়া ও গোলাম কাদের মারা গেছেন বলে ওয়াকিল আহমেদ জানিয়েছেন। বাকিদের মধ্যে শুধু আইয়ুব আলী ও সোলায়মান কারাগারে আছেন।

মৃতদের সাজা ঘোষণা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত জেলা পিপি লোকমান হোসেন চৌধুরী বলেন, তারা মারা গেছেন বলে তিনিও জেনেছেন। তবে বিষয়টি মামলার নথিতে উল্লেখ না থাকায় আদালতের নজরে আসেনি।

আসামিদের মধ্যে সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত আবদুল হকের সঙ্গে জমি নিয়ে ওই পরিবারের বিরোধ চলছিল। ১৯৯১ সালের ১৭ মার্চ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সদরের দিকে যাওয়ার সময় আসামিরা দুই ভাই ছবুর আহমদ ও কবির আহমদকে রিকশা থেকে নামিয়ে সৈয়দনগর বারইপাড়া এলাকার খাল পাড়ে নিয়ে যায়।

সেখানে দুই ভাইয়ের মাথায় এসিড ঢেলে দেয় এবং খেজুর কাঁটা দিয়ে তাদের চোখ উপড়ে ফেলে। এতে ছবুর ও কবির একটি করে চোখ হারান। এদের মধ্যে কবির কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী লোকমান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ মামলায় ১৯৯২ সালে অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২০০৩ সালে।

“মামলার বাদি সাক্ষী দিতে আসেন ২০০৩ সালে। আসামিদের দিক থেকে হয়ত তারা চাপে ছিল। মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয় ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় যুক্তিতর্ক।”

তিনি জানান, ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে কোনো বার্ন ইউনিট ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুইজন চিকিৎসক দুই ভাইয়ের মেডিকেল পরীক্ষা করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ২০০৮ সালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। অন্য চিকিৎসক মারা গেছেন বলে খবর পেয়েছেন তারা।

“সাক্ষ্যগ্রহণে দীর্ঘ সময় লাগা, অনেক সময় আদালত বিচারক শূন্য থাকা এবং আসামি পলাতক থাকাসহ নানা কারণে দীর্ঘ ২৭ বছর পর এ মামলার রায় হলো।”

এই মামলার চলার মধ্যে ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর আইয়ুব আলীসহ কয়েকজন মিলে ভুক্তভোগীদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহানকে তুলে নিয়ে যান।

উপজেলার শিশুতল পাহাড়ে নিয়ে তাকে হত্যার পর লাশ পুঁতে ফেলা হয়। এক সপ্তাহ পর সোবহানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর ১২ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

দুই ভাইয়ের চোখ উপড়ানোর এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন কি না জানতে চাইলে ওয়াকিল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই এক ঘটনায় পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কোথাও যাব না।”