মহিউদ্দিন চৌধুরীর চট্টলার নেতা হয়ে ওঠা

পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবনে জেল-জুলুম সয়েছেন, মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে চালিয়ে গেছেন সংগ্রাম, মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন নগরবাসীর উন্নয়নে কাজের ভাবনায়- মহিউদ্দিন চৌধুরী তাই হয়ে উঠেছেন সব দল মতের চট্টগ্রামবাসীর নেতা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2017, 08:42 PM
Updated : 15 Dec 2017, 09:14 PM

প্রায় এক যুগ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া মহিউদ্দিন বন্দরনগরীর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন দেড় যুগের বেশি সময়।

৭৩ বছর বয়সে শুক্রবার মারা যাওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে; বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের উত্তাল সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

ষাটের দশকের ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য

চট্টগ্রামের এই রাজনীতিকের ভূমিকা স্মরণে করে অধ্যাপক অনুপম সেন বলেছেন, ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিদ্রোহ, ’৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্নদের জীবন রক্ষা করে তিনি সাধারণ ছাত্র নেতা থেকে ‘গণমানুষের নেতায়’ পরিণত হন।

“সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে পরিণত করেছে জননেতায়। তিনি হয়েছেন চট্টগ্রামবাসীর নয়নমনি।”

মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর, রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে। বাবা রেল কর্মকর্তা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদুরা বেগম।

ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মহিউদ্দিন ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাশ করেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি।

১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সে সময় সংগঠনের সভাপতি মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বেই আইয়ূববিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয় চট্টগ্রাম।

১৯৭১ সালে ২ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে লালদীঘির মাঠে জনসভার ডাক দেন মহিউদ্দিন। সেই জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় তার নেতৃত্বে।

একাত্তরের ৭ মার্চ মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ছাত্র-কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন রেসকোর্সের জনসভায়।

পাগলের অভিনয় করে বিএলএফ কমান্ডার

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মার্চেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন মহিউদ্দিন। ধারাবাহিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে।

মহিউদ্দিন ভারতের হরিণা ইয়্যুখ ক্যাম্পে পৌঁছে দেখেন সেখানে তার নামেই করা হয়েছে ‘শহীদ মহিউদ্দিন ব্যারাক’। পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন করে মহিউদ্দিনকে মেরে ফেলেছে-এমন ধারণা থেকে ওই ব্যারাকের নামকরণ করা হয়েছিল।

ভারতের উত্তর প্রদেশের তান্দুয়া কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ শেষে ‘মাউন্ট ব্যাটালিয়ন’র প্লাটুন কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী, যখন যুবক

পরে বিএলএফ-এর মিডল ও সাউথ কলামের কমান্ডার হন তিনি। পাহাড়ি এলাকায় তিনশ মুক্তিযোদ্ধার দলের নেতা হিসেবে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

বিজয়ের পর একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে চট্টগ্রামে ফেরেন মহিউদ্দিন ও তার সহযোদ্ধারা। পরে শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন।

চেয়েছিলেন প্রতিশোধ নিতে

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর গ্রেপ্তার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। মুক্তি পেয়ে প্রতিশোধ নিতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’।

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুক্ত এলাকা ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল মহিউদ্দিনের। ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হয় তাকে। কলকাতায় পালিয়ে যান তিনি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরী

কলকাতার পলাতক জীবনে চা দোকানে কাজ নেন। রেল স্টেশনে পত্রিকা বিক্রি থেকে সাব-কন্ট্রাক্টারি সবই করেছেন দলের নেতাকর্মীদের সাহায্য করার জন্য।

অনুপম সেন বলেন, মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বিদ্রোহী হয়েছিলেন মহিউদ্দিন।

১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন। ১৯৮৬ সালে রাউজান এবং ১৯৯১ সালে নগরীর কোতোয়ালি আসন থেকে সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হন।

হাজারো মানুষের চিকিৎসা

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর মুসলিম হলে ক্যাম্প স্থাপন করে অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয়ে খোলেন লঙ্গরখানা। নিজ হাতে দাফন করেন ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের।

ড. অনুপম সেন বলেন, “সেই বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।”

১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর চট্টগ্রামে হিন্দু বাড়ি এবং মন্দিরে হামলা হলে মধ্যরাতে দলবল নিয়ে পাহারায় নামেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রথমবার প্রার্থী হয়েই বিপুল ভোটে জয়ী হন। তখন বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের জন্য এ জয় ছিল বড় উদ্দীপনা।

মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী

এরপর থেকেই চট্টগ্রামবাসীর ‘মেয়র সাব’ (মেয়র সাহেব) মহিউদ্দিন।

১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে অসহযোগ আন্দোলন চট্টগ্রামে সফল হয় মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে।

২০০০ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৫ সালের ৫ মে তৃতীয় দফায় মেয়র নির্বাচনে সারারাত পাহারা দিয়ে নেতার বিজয় নিশ্চিত করে ভোরে ঘরে ফেরে তার কর্মী-সমর্থকরা।

প্রায় ১৬ বছর একটানা মেয়র পদে থাকাকালে নগরীর পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে মহিউদ্দিনের অবদান সারা দেশে প্রশংসিত হয়।

সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন চৌধুরী

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ‘সেবক’ উপাধি দিয়ে তাদের ‘নয়নমনিতে’ পরিণত হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন থিয়েটার ইনস্টিটিউট।

সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মাতৃসদন, স্কুল-কলেজ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন মহিউদ্দিন। হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে নগরবাসীকে স্বস্তি দেন তিনি।

‘আপসহীন’ মহিউদ্দিন

২০০১ বেসরকারি উদ্যোগে বন্দর চ্যানেলে এসএসএ পোর্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেই আন্দোলনের ডাক দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

লালদীঘির মাঠে জনসভা করে তিনি ঘোষণা দেন, “বন্দর স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে চট্টগ্রাম থেকে এক টাকাও যাবে না।” 

২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মহিউদ্দিন। এর আগে প্রায় দুই যুগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্ববধায়ক সরকার আমলে মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর ক্যান্সারে মারা যায় তার মেয়ে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্তাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে গ্রেপ্তার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই তার মেয়ে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার ক্যান্সার ধরা পড়ে।

ব্যাংককে চিকিৎসাধীন মেয়েকে দেখতে পরিবার প্যারলে মুক্তি চাইলে মহিউদ্দিনকে ‘রাজনীতি ছাড়ার’ শর্ত দেওয়া হয়। মেয়েকে মৃত্যুশয্যায় দেখতে না পেলেও সেই শর্ত মানেননি চট্টলবীর।

২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর মহিউদ্দিন জামিনে মুক্ত হলেও ব্যাংককে পৌঁছার আগেই মারা যায় তার মেয়ে টুম্পা।

এক সময়ের ‘রাজনৈতিক শিষ্য’ মনজুর আলমের কাছে ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন তিনি

২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনে নিজের ‘রাজনৈতিক শিষ্য’ মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হন তিনবারের মেয়র মহিউদ্দিন। ওই নির্বাচনের আগে নগরীর জলাবদ্ধতা, নালার উপর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং গোশালার জমি ইস্যুতে সমালোচিত হন তিনি।

২০১৪ সালের নভেম্বরে ঘোষিত কমিটিতেও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মহিউদ্দিন। ওই কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হন সাবেক ছাত্রনেতা আ জ ম নাছির উদ্দিন, যিনি এখন চট্টগ্রামের মেয়র।

২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হতে নিজের আগ্রহের কথা জানান মহিউদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেন নাছিরকে।

২০১০ সালের পর থেকে দলনেত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার মহিউদ্দিনকে মন্ত্রী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দিলেও তাতে রাজি হননি তিনি। চট্টগ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন বারবার।

মহিউদ্দিন চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের অনেকের প্রিয় মানুষ

নাছির মেয়র হওয়ার পর কিছুদিন নীরব থাকলেও নগরীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আবার সরব হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। নিজ দলের মেয়র ও সাংসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পিছপা হননি তিনি।

সবশেষ হোল্ডিং ট্যাক্স পর্নমূল্যায়নের বিরুদ্ধে নগরবাসীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে অসুস্থ শরীরেও সোচ্চার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

অসুস্থ হয়ে বারবার ফিরতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রামেই। দেশে-বিদেশে এক মাস চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রামে ফেরার দুই দিনের মাথায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পান তার বড় ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।