‘দেহরক্ষীকে বলেছিলাম, ধরা পড়লে গুলি করতে’

ফ্রান্সে পাকিস্তানি সাবমেরিনে কর্মরত অবস্থায় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি; নিজের দেহরক্ষীকে বলে রেখেছিলেন, পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়লে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2016, 02:47 PM
Updated : 30 Dec 2016, 02:47 PM

১৯৭১ সালে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনাকারী নৌ কমান্ডোদের দলনেতা আবদুল ওয়াহেদ (এ ডব্লিউ) চৌধুরী ৪৫ বছর পর মুক্তির সেই অভিযানের স্মৃতিচারণ করলেন।

শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বীর উত্তম ও বীর বিক্রম খেতাব পাওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

পাকিস্তান নৌ বাহিনীর সদস্য এ ডব্লিউ চৌধুরী ১৯৭১ সালে ফ্রান্স থেকে পলায়নের পর অপারেশন জ্যাকপট পর্যন্ত ঘটনাবলীর বর্ণনা দেন।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ যখন শুনি তখন আমি ফ্রান্সে। আট জনকে নিয়ে সেখান থেকে বের হলাম। এ পলায়ন ছিলো বিদ্রোহ। ধরে ফেললে আমাদের গুলি করে হত্যা করত। পালিয়ে আসার সময় ধরা পড়লাম জেনেভাতে।

“ফিরে এলাম লিও। সেখান থেকে বার্সেলোনা হয়ে মাদ্রিদে ভারতীয় দূতাবাসে যাই ১০ এপ্রিল। ১০ মিনিটের আলোচনায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে গেলাম। তারপর ভারতে আসার পথে রোম বিমানবন্দরে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের ১০ ঘণ্টার বিলম্ব।”

তখন বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তানিরা তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচতে ভারতের বিশেষ ব্যবস্থায় তারা জেনেভা হয়ে বোম্বে ও সবশেষে দিল্লী পৌঁছান।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ফ্রান্সের তুলঁ নৌঘাঁটিতে পাকিস্তানের সদ্য কেনা সাবমেরিনে ম্যানগ্রো সাবমেরিনার হিসেবে কর্মরত ১৩ বাঙালির একজন ছিলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। ১ এপ্রিল তাদের ওই সাবমেরিন চালিয়ে পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল।

শুরুতে পালিয়ে আসা আট কমান্ডোকে দিয়ে অভিযানের পরিকল্পনা করা হলেও পরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও নৌ কমান্ডো তৈরির সিদ্ধান্ত মিত্রবাহিনী নেয় বলে জানান এ ডব্লিউ চৌধুরী।

তিনি বলেন, তখনো বাঙালিরা বড় কোনো হামলা করেনি। দেশের ভেতরে অনেকে ‘ডি-মরালাইজড’ এই ভেবে বুঝি দেশ স্বাধীন হবে না। ভারতীয়রা চিন্তা করল যত দ্রুত অপারেশন পরিচালনা করা যায়।

এ লক্ষ্যে একাত্তরের ২১ মে থেকে ৩১ জুলাই ভাগিরথী নদীর তীরে ৩০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৬০ জনের একটি দলের নেতৃত্ব নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হন এ ডব্লিউ চৌধুরী।

পলাশি থেকে ট্রাকে করে কলকাতা, সেখান থেকে বিমানে আগরতলা হয়ে হরিণা ক্যাম্প দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে তার দল।

তিনি বলেন, “কলকাতা থেকে আগরতলা যাওয়ার সময় বিমানে জেনারেল অরোরা কানে কানে বলেন- ‘ডু ইউ নো দ্য ডিটেইল’। বললাম- ‘নো স্যার’। তিনি বললেন- ‘মে বি দ্য ফিফটিন্থ।”

এই কথা বলে জেনারেল অরোরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌ-সেক্টর পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশন ‘অপারেশন জ্যাকপটকে’ বুঝাচ্ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মধ্য রাতের পর চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্র বন্দর এবং দেশের ভেতরে চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। ১০ নং সেক্টরের অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়া নৌ কমান্ডো যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার নিদর্শন ছিল এই অপারেশনটি।

আত্মঘাতী এই অপারেশন শেষ করে ফিরে আসার কোনো আশা তখন যে তাদের সামনে ছিল না, সেদিকে ইঙ্গিত করে এ ডব্লিউ চৌধুরী বলেন, “ফেরত যাওয়ার কথা কেউ বলেনি। আমাদের খরচের খাতায় রাখা হয়। কিন্তু পিছ পা হইনি। উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধে আসা। মুক্তিযুদ্ধ মানুষের জীবনে বারবার আসে না।”

আগরতলায় অবস্থানকালে অপারেশন জ্যাকপটের সময় নির্ধারণের বিষয়ে দুটি গান বাজানোর কথা জানানো হয়।

এ ডব্লিউ চৌধুরী বলেন, “আগরতলায় জেনারেল চৌধুরী আমাকে ও ডেপুটি লিডার ড. শাহ আলমকে ব্রাউন লেদারে মোড়ানো দুটো ট্রানজিস্টার দেন। ১ থেকে ৭ অগাস্ট প্রতিদিন সকাল ১১টা পর্যন্ত তিনি আমাদের দুটো গান শোনাতেন।

“তখন জানতাম না কেন? ভাবতাম একজন জেনারেল ডেকে নিয়ে শুধু গান শোনায় কেন। একটি ছিল- পঙ্কজ মল্লিকের ‘আমি যে তোমাকে শুনিয়েছি কত গান’। দ্বিতীয়টি ছিল- সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুর বাড়ি’।”

অপারেশনের সতর্ক সংকেত হিসেবে ঠিক করা ওই দুটি গান কলকাতা আকাশবানীর পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৬টা অথবা রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টায় প্রচার করার কথা ছিল। প্রচারের ফ্রিকোয়েন্সির নাম ও গান দুটির পেছনের এই কথা শুধু টিমের কমান্ডারই জানতো।

তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রথম গানটি বাজবে। সেটি যাত্রা শুরুর সংকেত। ২৪ ঘণ্টা আগে বাজবে আরেকটি।

প্রথম গানের অর্থ ছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। দ্বিতীয় গানের অর্থ ছিল- আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগের নির্দেশ।

অপারেশন জ্যাকপটের জন্য ১১ অগাস্ট ৬০টি ডেটোনেটর ও লিম্পেট মাইন নিয়ে তার দল সীমান্ত পাড়ি দেয় বলে জানান এ ডব্লিউ চৌধুরী।

“প্রতিরাতে ২০-৩০ মাইল হাঁটি। আর সকালে লুকিয়ে থাকি। ১৩ তারিখ চট্টগ্রাম শহরের ও আর নিজাম রোডে আসলাম। বিকেলে শুনলাম প্রথম গান। ১৪ তারিখ শুনলাম- আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুর বাড়ি। তার মানে রাত ১২টা থেকে একটার মধ্যে মাইন জাহাজে লাগাতেই হবে। তা না হলে ঘুমন্ত কুকুর জেগে যাবে।”

এ ডব্লিউ চৌধুরী বলেন, “আমার দেহরক্ষী খুরশিদকে সেদিন নিজের বন্দুক দিয়ে রেখেছিলাম। বলেছিলাম, ধরা পড়লে আমাকে গুলি করতে। পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়তে চাই না- এটা লজ্জার।”

১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট রাত ১১টা পর্যন্ত অভিযানে অংশগ্রহণে নির্ধারিত ২০ জনের একটি দল না পৌঁছানোয় বাকি ৪০ জন নিয়েই চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করার অভিযানের নির্দেশ দেন তিনি।

সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে এ ডব্লিউ চৌধুরী বলেন, “তুমুল বৃষ্টি ছিল। ১১টা জাহাজ টার্গেট করে জেলের বেশে ৪০ জন অবস্থান নেয়। তাদের মধ্যে ৩৩ জন জাহাজ ডোবাবে। আমার সঙ্গে ছিল বিধান ও সত্যেন।

“ঠিক ১২টা বাজার ৫-৬ মিনিট আগে রওনা দিই। পানির ছয় ফুট নিচে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসলাম। যে কোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারত।”

সেখান থেকে পালিয়ে সারারাত কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে কোনো এক বাড়ির গোয়াল ঘরে আশ্রয় নেন তারা। সকালে খবর পান ১১টা জাহাজের মধ্যে নয়টি ডুবে গেছে।

তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরকে আমরা অচল করে দিয়েছিলাম। সেই যে পাকিস্তানিদের মেরুদণ্ড ভাঙলো তারা আর দাঁড়াতে পারেনি। খেলায় জ্যাকপট সবসময় মিস হয় কিন্তু অপারেশন জ্যাকপট মিস হয়নি।”

এ ডব্লিউ চৌধুরী স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে কমোডর হিসেবে অবসর নেন তিনি।

প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক অধিবেশন উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

প্রেসক্লাবে যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী ফরিদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের সহ-সভাপতি শহীদ উল আলম, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ার ও সাধারণ সম্পাদক মহসীন চৌধুরী।