নির্বাচন কমিশন না থাকায় প্রজ্ঞাপন জারি নিয়ে রয়েছে জটিলতা। আবার সরকার সিটি মেয়রকে অপসারণ করায় রায়ের কার্যকারিতা নিয়ে থাকছে সংশয়।
Published : 02 Oct 2024, 12:19 AM
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সাড়ে তিন বছর পর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে মেয়র নির্বাচিত ঘোষণা করা হলেও মেয়রের চেয়ারে বসার সুযোগ তার এ দফা হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করায় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের এ রায় কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সময় রয়েছে এক মাস। কোনো আপিল আবেদন না হলে রায় অনুযায়ী গেজেট প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি আসবে। নিয়ম হল, রায় হাতে পাওয়ার পর সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা আইনি দিক পর্যালোচনা করে করণীয় ঠিক করবেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে গেজেট প্রকাশ নিয়েই জটিলতা হতে পারে। গেজেট প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের মিলিয়ে পুরো কমিশনের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর পুরো কমিশন পদত্যাগ করায় ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ইসি এখন শূন্য।
এ অবস্থায় নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নতুন কমিশন আসার পর গেজেট জারি হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে।
প্রবল আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সব সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়েছে। মেয়রকে সরানোর পর বসানো হয়েছে প্রশাসক।
এখন সব বিষয় অনুকূলে থাকলেও বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার শেষ পর্যন্ত কি পদক্ষেপ নেয় তা দেখতে কয়েকমাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।
কমিশন না থাকা অবস্থায় ইসি সচিবালয় নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ নেবে জানতে চাইলে ইসি সচিব শফিউল আজিম বলেন, “আগে রায়টা আমরা পেয়ে নিই। তাহলে আমরা সার্বিক বিষয় বুঝতে পারব। আমাদের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে, লিগ্যাল উইং রযেছে। দরকার হলে আমরা লিগ্যাল ওপিনিয়ন নেব।”
কিন্তু এক্ষেত্রে ইসি সচিবালয়ের এখতিয়ারের যে সীমাবদ্ধতা আছে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “রায়ের ভেতরে আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে থাকলে যতটুকু করার দেখব। এখন তো কমিশন নেই, সেক্ষেত্রে লিগ্যাল এক্সপার্টদের মতামত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
একই সুরে কথা বলেন ইসি সচিবালয়ের আইন শাখার যুগ্মসচিব ফারুক আহমেদ।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের কপি আগে আসুক। এরপর আমরা আইনগত মতামত দেব। আইনি দিক পর্যালোচনা করে কমিশন আইনে কি আছে, স্থানীয় সরকার বিধিমালায় কি আছে- সংশ্লিষ্ট আইন পর্যালোচনা করে আমরা মতামত দেব।”
তবে সরকার ইতোমধ্যে গেজেট করে সকল সিটি মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক বসানোর কারণে নির্বাচনী ট্রাইবু্ব্যুনালের আদেশ ‘অকার্যকর’ হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা এ আইন কর্মকর্তার।
সাড়ে তিন বছর পর রায়
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি। তাতে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পান ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট।
কিন্তু ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাহাদাত।
সেখানে বলা হয়, রেজাউল করিম নৌকা প্রতীক পাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় নির্বাচনের নামে ওইদিন শুধু ‘আনুষ্ঠানিকতা’ হয়েছে।
“যে কারণে নির্বাচনে ভোটের হিসাব চেয়ে পাওয়া যায়নি। কোনো কেন্দ্র থেকে ইভিএমের প্রিন্ট কপি দেওয়া হয়নি। ভোটের দিন দুপুর পর্যন্ত ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোট পড়ে। কিন্তু ভোটের হিসাবে দেখানো হয় ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে।”
চট্টগ্রামের নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ খাইরুল আমীন মঙ্গলবার দুপুরে সেই মামলার রায় দেন।
সেখানে বলা হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র হিসাবে ‘নৌকা প্রতীকের’ প্রার্থী ১ নম্বর বিবাদী মো. রিজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচিত ঘোষণার আদেশ বাতিল করা হল। মামলার বাদী ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত মেয়র ঘোষণা করা হল। আদেশ পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত মেয়র হিসাবে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হল। রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি সিটি নির্বাচন বিধিমালার ৬৬ ধারা অনুযায়ী ইসির কাছে পাঠাতে বলা হল।
রায় ঘোষণার পর ডা. শাহাদাত সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে নির্বাচন কমিশন সচিবকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করে আমাকে মেয়র পদে আসীন করার জন্য।”
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীকে অপসারণ করেছে। ১৯ অগাস্ট তার জায়গায় প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার।
তাহলে এই রায়ের পর মেয়র পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কীভাবে হবে জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেনের আইনজীবী মফিজুল হক ভুঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়টি পেলে এ বিষয়ে কি নির্দেশনা আছে তা আমরা জানতে পারব। তবে রায়ের যেটুকু জানি, তাতে বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে গেজেট করে ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র পদে আসীন করাতে হবে।”
যা বলা আছে আইনে
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯, এ নির্বাচনী বিরোধ বিষয়ে বলা হয়েছে-
>> নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল ও নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন ৩৮ (১) ধারা: এ আইনের অধীন নির্বাচন সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশন একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল এবং একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও একজন উপযুক্ত পদমর্যাদার নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে।
>> নির্বাচনি ফলাফল গেজেটে প্রকাশের ত্রিশ দিনের মধ্যে উপ-ধারা (১) এর অধীন গঠিত নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা যাবে এবং নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল কর্পোরেশনের নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো মামলা দায়ের করার একশ আশি দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে।
>> নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় ঘোষণার ত্রিশ দিনের মধ্যে উপ-ধারা (১) এর অধীন গঠিত নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল দায়ের করা যাবে এবং নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনাল কর্পোরেশনের নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো আপিল দায়ের করার একশ আশি দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে।
>> নির্বাচনি আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
কমিশন শূন্য, ইসি সচিবালয় কী করতে পারে
ইসি সচিবালয়ের নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ-সচিব মো. আতিয়ার রহমান জানান, নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ৩০ দিন সময় রয়েছে। আপিলের সময় পর্যন্ত ইসি গেজেট প্রকাশ করতে পারে না।
“আবার নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দিয়েছে ইসি। ফলে কমিশন ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে না। কিন্তু আপিলের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে বিবাদী পক্ষ বা সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ যদি আপিল করে, তাহলে আপিল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।”
এ কর্মকর্তা বলছেন, কোনো ভোটের গেজেট প্রকাশ করতে হলে পুরো কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। বিগত কমিশন পদত্যাগ করায় সে অনুমোদন নেওয়ার সুযোগ এখন নেই। তাই নতুন কমিশন না আসা পর্যন্ত কেউ আপিল না করলেও গেজেট প্রকাশ নিয়ে আইনগত জটিলতা হতে পারে।
ইসির আইন শাখার যুগ্ম সচিব ফারুক আহমেদ বলেন, “এখন তো কমিশন নেই। কমিশনের অনুমোদনের আগে হয়ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, উপদেষ্টা পরিষদ পর্যন্ত যেতে পারে। কমিশনের অনুপস্থিতিতে বিকল্প কী ব্যবস্থাপনা করা যায়, সেটা পর্যালোচনা না করে এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।”
এ কর্মকর্তা বলেন, “এখন যেহেতু স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে, নতুন প্রশাসক নিয়োগ হয়েছে, ফলে এটা (রায়) বেশি একটা কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ কমিশন থাকা অবস্থায়ও যদি উনি নির্বাচিত হতেন, কি হত? উনার নামে গেজেট হত। ওই যে বাতিলের প্রজ্ঞাপনটা জারি করেছে, সেটা জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটির মত বাতিল করে দিতেন।
“আগে হলে সেটাই হত। এখন তো ওই পরিষদগুলোই বাতিল। যে পরিষদটা ছিল নির্বাচিত, ওইটাই তো বাতিল। স্থানীয় সরকারের আদেশে যেহেতু বাতিল হয়ে গেছে, এটা বোধ হয় অনেকটা অকেজো।”
পুরনো খবর
এবার সিটি করপোরেশন-পৌরসভার কাউন্সিলরদের অপসারণ
মেয়রদের সরিয়ে ১২ সিটিতে প্রশাসক
জনপ্রতিনিধিদের অপসারণে আইনি পথ তৈরি করে অধ্যাদেশ জারি
মেয়রদের সরিয়ে ১২ সিটিতে প্রশাসক
ভোটের সাড়ে তিন বছর পর শাহাদাতকে চট্টগ্রামের মেয়র ঘোষণার রায়