মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলছেন, চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে হলে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, একা কেউ পারবে না।
Published : 14 Aug 2023, 09:39 PM
পাল্টাপাল্টি অবস্থানের চারদিন পর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সমন্বয় করে কাজ করা হবে বলে আশ্বস্ত করলেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী।
সোমবার বিকেলে টাইগারপাসের অস্থায়ী নগর ভবনে সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বন্দর ও স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে আন্তঃদপ্তর সমন্বয় সভা শেষে মেয়র এ কথা বলেন।
সভা শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে মেয়র বলেন, “সবাই একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। যে সমস্ত ত্রুটি আছে, সব সংস্থা ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে আলোচনার মাধ্যমে এগুলা আমরা সমাধান করব। এবং আমরা কাজ এগিয়ে নেব।
“যার যার ত্রুটি উনিই জানে। আমরা যদি বলি, ওয়াসার জন্য এখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, তখন ওয়াসা চিন্তা করবে কীভাবে এটাকে সরানো যায়।”
মেয়র রেজাউল বলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে হলে আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বন্দর, সড়ক ও জনপথ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
“ব্রিজের নিচ দিয়ে ওয়াসা, গ্যাস, টিঅ্যান্ডটির পাইপ গেছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের পিডি একটা পরিসংখ্যান দিয়েছেন। যেসমস্ত জায়গায় এখনো প্রতিবন্ধতা আছে সেগুলো যদি আমরা একসাথে বসে কাজ করি...। এককভাবে কেউ পারবে না।"
মেয়র রেজাউল বলেন, “শুধু ইউটিলিটি লাইন নয়, যেমন- পাহাড় কাটা যদি বন্ধ না হয় তাহলে মাটি আসবে নালাতে। নালা থেকে যাবে খালে। এটা বন্ধ করতে না পারলে খাল খনন করলেও আগামী বছর ভরে যাবে।
“পরিবেশসহ সব সংস্থা, আমরা যদি সিরিয়াস হই পাহাড় কাটা অনেকাংশে কমে যাবে। আমরা সিরিয়াস বলে পলিথিনের ব্যবহার আগের থেকে কমেছে।”
সোমবারের সমন্বয় সভায় সিডিএ এর চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ উপস্থিত ছিলেন না। তবে সিডিএ এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান এবং জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী উপস্থিত ছিলেন।
‘সহজ ভাবে নেওয়াই ভালো’:
গত ৩ অগাস্ট বিকাল থেকে টানা বর্ষণে প্রায় চার দিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ছিল জলাবদ্ধ। কিছু এলাকায় বাড়িগুলোর নিচতলাও ডুবে যায়। দোকান ও বিপণি কেন্দ্রে ঢোকে পানি।
দুর্ভোগময় এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মেগা প্রকল্পসহ দুটি প্রকল্প, সিটি করপোরেশনের একটি প্রকল্প ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটিসহ মোট চারটি প্রকল্প চলমান থাকার পরও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা শুরু হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী সিডিএ এর মেগা প্রকল্পের কাজে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তোলেন।
এর জবাব দিতে গত বুধবার সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিন সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, সব দায় তার সংস্থার উপর চাপানোর চেষ্টা করা ‘ঠিক হচ্ছে না’।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (সিসিসি) না পারায় সিডিএকে এ প্রকল্পের কাজ দিয়েছে সরকার। সিডিএর সক্ষমতা না থাকলে কি সিডিএকে কাজ দিত? উনাদের (সিসিসি) যোগ্যতা থাকার পরও কাজ আদায় করতে পারছেন না কেন?
সোমবার সমন্বয় সভায় সিডিএ চেয়ারম্যানের বক্তব্য বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র রেজাউল বলেন, “প্রত্যেকটা সংস্থার সক্ষমতা আছে। কোনো সংস্থার সক্ষমতা নেই এ কথাটা ঠিক না। উনি বলার ফাঁকে বলে ফেলেছেন। এটাকে নিয়ে আমরা টানাহেঁচড়া না করাই ভালো। কথা বলতে গেলে স্লিপ অব টাং হতে পারে।
“হয়ত সিডিএ চেয়ারম্যান সাহেব কথাচ্ছ্বলে বলে ফেলেছেন। এটাকে দৃঢ়ভাবে না ধরে সহজ ভাবে ধরে নেয়াই ভালো।”
সভায় সিডিএ চেয়ারম্যান না আসার বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, “তিনি হয়ত কোনো কাজে আসতে পারেননি। প্রকল্প পরিচালক এসেছেন। প্রকৌশলী এসেছেন। উনারা সভায় উনাদের বক্তব্য রেখেছেন।”
সংস্থার প্রধানরা না এলে সমন্বয় কার্যকর হয় কিনা প্রশ্ন করা হলে মেয়র বলেন, “আজ এখানে যারা এসেছেন তারা সবাই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। উনারা দায়িত্ব নিয়ে নিজ নিজ সংস্থার পক্ষে কথা বলতে পারছেন।
“সমন্বয় হয় বলেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় জেলা প্রশাসক আসেন। আমরা একসাথে সবাই বসি। আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করে চট্টগ্রামের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারব। সমন্বিতভাবে যদি কাজ করি আমাদের সফলতা আসবে। কারণ সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমাদের সবাইকে নিতে হবে। চট্টগ্রামে যত সেবা সংস্থা আছে আমরা সবাই একযোগে যত সমস্যা আছে সব সমাধানে কাজ করব।”
দীর্ঘ জলাবদ্ধতার ‘চার কারণ’
সভা শেষে মেয়র রেজাউল এবারের টানা জলাবদ্ধতার জন্য অতিবৃষ্টি, কর্ণফুলী নদীর ধারণক্ষমতা হ্রাস, নগরীতে জলাধার না থাকা এবং প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “নগরীতে যত বিল ছিল সেই বিরাণ ভূমিগুলোতে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সেখানে দালানকোঠা হয়েছে। হয়ত মানুষ ভরাট করে ফেলেছে। যার ফলে পানি যাওয়ার রাস্তা নেই। পানি যাওয়ার একমাত্র রাস্তা নদী। নদীরও ঠিক একই অবস্থা।
“পানি উঠবে, এটার কারণও আছে। কর্ণফুলী নদীরও ধারণক্ষমতা কমেছে। ৭ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। কষ্ট করে সেখানে ড্রেজিং করছে। সেখানে চার মিটারের মত পলিথিন।”
তিনি বলেন, “এখানে একটা কথা বলে রাখি, পানি উঠবে। পৃথিবীর উন্নত শহরগুলোতেও পানি উঠছে। কিন্তু পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হচ্ছে কিনা এটাই হচ্ছে আসল কথা। যদি বলেন যে না, এই প্রকল্প হলে পানি আর উঠবে না- সেটাও কিন্তু ঠিক না।
“চট্টগ্রামে একসময় ৭২টা খাল ছিল। পরে তালিকায় নগরীতে খাল ছিল ৫৭টা। প্রকল্পের অধীনে কাজ চলছে ৩৬টিতে। প্রকল্পের বাইরে ২১টা খাল আছে। এরমধ্যে অনেক খালের অস্তিত্ব নেই। অনেক খাল প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। ভরাট হয়ে গেছে। এগুলো খননের জন্য আমরা জানিয়েছি।”
মেয়র রেজাউল বলেন, “অনেক খালের মাটি এখনো পুরোপুরি তোলা হয়নি। স্লুইস গেইট গুলো এখনো কাজ সম্পন্ন হয়নি। পাম্পহাউজ গুলোর কাজও শেষ হয়নি। স্লুইস গেইট গুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় জোয়ারের পানি শহরে ঢুকে পড়েছে।
“প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। কাজ কিন্তু পুরোপুরি শেষ হয়নি। কাজ শেষ না হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা সমীচিন নয়। আর এবার যে পানি এর একমাত্র কারণ বিগত ৩০ বছরে এ ধরণের প্রবল বৃষ্টিপাত হয়নি।”
প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ এক বছরের মধ্যে শেষ হবে জানিয়ে মেয়র রেজাউল বলেন, “আমাদের বাড়ইপাড়া খালের কাজও দেড় বছরের মধ্যে শেষ হবে। তখন সুফল মিলবে।”
সিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মু. আনোয়ার পাশা, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী মাহমুদুল হোসেন খান, সিডিএ সচিব মো. মিনহাজুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু রায়হান দোলন, নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এম এ মাসুদ, সিসিসি’র সচিব খালেদ মাহমুদ, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মুনিরুল হুদা, কর্ণফুলী সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক রাজীব দাশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিরা।