নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজে ভালো করতে পারলে বাংলাদেশের নিয়মিত টেস্ট অধিনায়কও হয়ে যেতে পারেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
Published : 27 Nov 2023, 06:53 PM
সিলেটে পর্যটন মৌসুম বলে আলাদা করে কিছু নেই। বছরজুড়েই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। শহরের পথেঘাটে, আশেপাশে চা বাগানগুলোয়, নানা প্রান্তে দেখা যায় ছুটোছুটি করছেন পর্যটকরা। তাদের চোখে থাকে খুশির ছটা, মুখে হাসি। এই শহরেরই লাক্কাতুরা এলাকায় ক্রিকেট মাঠে নাজমুল হোসেন শান্তকে দেখে মনে হলো, তিনিও দারুণ উপভোগ করছেন এই আঙিনায় বিচরণ!
অবশ্যই তিনি পর্যটক নন। সিলেটে ঘুরতেও আসেননি। বরং তার কাঁধে গুরুভার। সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্টেডিয়ামে সোমবার তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ঠিকরে বের হচ্ছিল আনন্দ। গা গরম করা, উইকেট দেখা, কোচের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ, নির্বাচকদের সঙ্গে কথোপকথন, নিজের ব্যাটিং, সতীর্থদের সঙ্গে কথা কিংবা খুনসুটি, টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলন, সবকিছুই যে তিনি দারুণ আনন্দ নিয়ে করছেন, বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অধিনায়কত্বের প্রহর দারুণ উপভোগ করছেন শান্ত।
তাকে অবশ্য স্রেফ অধিনায়ক বললেন ভুলই হবে। আগে ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দটি যোগ করতে হবে। সাকিব আল হাসানের চোট ও লিটন কুমার দাসের ছুটির কারণেই নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজের অধিনায়ক তিনি। তবে এই সিরিজ তার জন্য এক দিক থেকে বলা যায় ‘ট্রায়াল।’ এই পরীক্ষায় যদি তিনি উতরে যেতে পারেন, ‘ভারপ্রাপ্ত’ শব্দটি বদলে গিয়ে সামনে রূপ নিতে পারে ‘নিয়মিত।’
তার এই পরীক্ষা অবশ্য টুকটাক চলছে গত কিছুদিন ধরেই। বিশ্বকাপের আগে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে তিনি নেতৃত্বে দিয়েছিলেন সাকিব-লিটনের অনুপস্থিতিতেই। এরপর বিশ্বকাপ দলে তার ‘প্রমোশন’ হয় ওয়ানডের আনুষ্ঠানিক সহ-অধিনায়ক হিসেবে। বিশ্বকাপে গিয়ে সাকিবের আঙুলের চোটে আরও দুটি ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ তিনি পান। সেই ম্যাচ দুটিও ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে।
দল জেতেনি কোনো ম্যাচেই। তবে অধিনায়কত্বের পরীক্ষায় যে তিনি একটু একটু করে উতরে যাচ্ছেন, সেটির প্রমাণ এই টেস্ট সিরিজ। সাকিব-লিটনরা না থাকায় নেতৃত্ব পেতে পারতেন মেহেদী হাসান মিরাজও। কিন্তু শান্তকে দায়িত্ব দেওয়ায় প্রমাণ, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অধিনায়ক হিসেবে বিসিবির কাছে এখন তিনিই এগিয়ে।
ওয়ানডেতে নতুন অধিনায়ক সামনে এমনিতেও লাগবে। বিশ্বকাপের আগেই টি-স্পোর্টসে সাক্ষাৎকারে সাকিব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বকাপের পর একদিনও অধিনায়ক থাকবেন না তিনি। ওই সাক্ষাৎকারেই সাকিব বলেছিলেন, বিশ্বকাপের পর আর টেস্ট ক্রিকেটও খেলতে চান না। এখন তো আরও জাতীয় নির্বাচনের লড়াই এবং রাজনৈতিক ব্যস্ততা মিলিয়ে তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেললেই তা হবে বিস্ময়কর। সেক্ষেত্রে, নতুন টেস্ট অধিনায়কও ঠিক করতে হবে বিসিবিকে।
টেস্টের আনুষ্ঠানিক সহ-অধিনায়ক লিটনের নামও এখানে আসবে নিশ্চিতভাবেই। তবে ওয়ানডের সহ-অধিনায়কত্ব থেকে যেভাবে তিনি সরে গেছেন বা সরানো হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, তিনিও আপাতত একটু পেছনে। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য সেরা বিকল্প হিসেবে শান্তর ছবিটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে স্পষ্ট।
সেক্ষেত্রে এই সিরিজ নিশ্চিতভাবেই তার জন্য নিজেকে মেলে ধরার বড় সুযোগ। ব্যাট হাতে ভালো কিছু করার পাশাপাশি নেতৃত্বের ছাপ কিছুটা হলেও যদি রাখতে পারেন তিনি, নিশ্চিতভাবেই ‘ভারপ্রাপ্ত’ থেকে অধিনায়কের সত্যিকার ভার তিনি পাবেন।
শান্ত নিজেও যে সেই ভার বইতে মুখিয়ে আছেন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। শুরুতেই বলা হয়েছে, কতটা আনন্দ নিয়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় দলের আগেই বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি অধিনায়কত্ব করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার পর দীর্ঘদিন ধুঁকলেও এখন দলে জায়গা মোটামুটি থিতু। নিজের অন্যান্য দিকও এখন ফুটিয়ে তুলতে পারছেন। সেখানে নেতৃত্বগুণের আভা কিছুটা ছড়াতে পারছেন বটে। ক্রিকেট নিয়ে তার চিন্তাভাবনার ধরন, নিজেকে যেভাবে পরিচালনা করেন, তার ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্ব, সবকিছুতে নেতৃত্বের গুণাবলী কিছুটা ফুটে ওঠে বটে।
নেতৃত্বের প্রতি অনুরাগ তিনি কথায়ও পরিষ্কার করে দিয়েছেন বারবার।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযানের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়াই শেষে সোজাসাপ্টাই বলেছিলেন, নিয়মিত অধিনায়ক হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত মনে করছেন তিনি। সেটা কি শুধুই ওয়ানডের জন্য নাকি সবকিছু, সেটিও তিনি খোলাসা করলেন টেস্ট নেতৃত্ব শুরুর আগের দিন। পাশাপাশি সরাসরিই জানিয়ে রাখলেন, লম্বা সময়ের জন্যই দায়িত্বটি পাওয়ার আশা আছে তার।
“অধিনায়ক তো অধিনায়কই। তখন যেটা বলেছি (বিশ্বকাপ শেষে)… আমার মনে হয় সব ফরম্যাটের জন্যই ওই সামর্থ্য আমার আছে। এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।”
“আর দলের এই অবস্থা… সত্যি বলতে, যে-ই অধিনায়ক হবে, যদি লম্বা সময়ের জন্য হয়, দল নিয়ে তার পরিকল্পনা সাজাতে সুবিধা হবে। সামনে যে-ই আসবে, যদি পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, অনেক ভালো কিছু করবে এবং তার পরিকল্পনা করতে অনেক সুবিধা হবে।”
যে তিনটি ওয়ানডেতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিশেষ করে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে, সেখান থেকে কিছুটা সমৃদ্ধও হয়েছেন। এবার সংস্করণ যদিও আলাদা, চ্যালেঞ্জ আরও বিশদ, তবু ওই অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শিক্ষা তিনি কাজে লাগাতে চান।
“সুনির্দিষ্টভাবে কী শিখেছি, এটা বলা মুশকিল। ওটা ওয়ানডে ছিল, এটা টেস্ট ম্যাচ। তবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আরেকটু কী ভালো করতে পারতাম, মাঠ সাজানো কেমন হতে পারে, বোলিং পরিবর্তন কাকে দিতে পারতাম… এরকম ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো বুঝতে পেরেছি।”
অধিনায়ক হিসেবে তিনি কোন ঘরানার, এটা স্পষ্ট হবে সময়ের সঙ্গে। তবে তার ভালো লাগে মাহেন্দ্র সিং ধোনির ধরন। বিশেষ করে ধোনির একটি দিক তিনি অনুসরণ করতে চান প্রবলভাবে। সেখানে আবারও ফুটিয়ে তুললেন লম্বা সময়ের জন্য তার নেতৃত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
“ধোনি অবশ্যই খুব শান্ত থাকতেন, ধীরস্থির থেকে সিদ্ধান্ত নিতেন। মাঠের ভেতর তার নানারকম সিদ্ধান্ত, ট্যাকটিক্যাল ব্যাপার, এসব নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত তার মাঠের বাইরের অধিনায়কত্ব, যেভাবে তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতেন।”
“২০-২৫ জন ক্রিকেটারকে বাছাই করে তিনি ২-৩ বছরের পরিকল্পনা করতেন। তাদেরকে সেভাবেই প্রস্তুত রাখতেন এবং সবার পাশে থাকতেন। কোনো এক পজিশনে কেউ ব্যর্থ হলে বা কোনো কারণে কাউকে পাওয়া না গেলে, তার উপযুক্ত বিকল্প প্রস্তুত থাকত। এভাবে দলকে স্থিতিশীল রাখতেন তিনি। ধোনির এই ব্যাপারটাই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত। তবে এটার জন্য লম্বা সময়ের জন্য দায়িত্ব পেতে হবে। দুই ম্যাচের জন্য দায়িত্বে এসব ভেবে লাভ নেই।”
দুই ম্যাচের দায়িত্বে এসব ভেবে লাভ নেই বটে। তবে এই দুই ম্যাচে নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকঠাক করতে পারলে হয়তো দুই বছরের জন্যই দুয়ার খুলে যাবে তার!