২০০৩: আফ্রিকায় অস্ট্রেলিয়ার উৎসব, বাংলাদেশের আঁধার

সামর্থ্যের যে ঝলক অস্ট্রেলিয়া দেখিয়েছিল ইংল্যান্ডে, আফ্রিকায় এসে তা পায় পূর্ণতা। দ্বিতীয় দল হিসেবে হয় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, ধরে রাখে শিরোপা। একমাত্র দল হিসেবে জিতে তিনটি বিশ্বকাপ। আগের আসরে বিশ্বকাপ অভিষেকে স্বপ্নময় টুর্নামেন্টের পর বাংলাদেশের জন্য ২০০৩ বিশ্বকাপ ছিল যেন দুঃস্বপ্ন।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2019, 11:55 AM
Updated : 25 May 2019, 10:24 AM

৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ বিশ্বকাপের অষ্টম আসরের মূল স্বাগতিক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সঙ্গী ছিল জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ পেয়ে টেস্ট পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ খেলার জন্য তাই আর আইসিসি ট্রফিতে খেলতে হয়নি তাদের। ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়া কেনিয়াও সরসারি পায় টুর্নামেন্টের টিকেট। আইসিসি ট্রফি পেরিয়ে আসে নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও প্রথমবারের মতো নামিবিয়া। দল বাড়ায় বাড়ে ম্যাচও, সব মিলিয়ে হয় ৫৪ ম্যাচ।

পুল ‘এ’ তে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গী ছিল ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, নেদারল্যান্ডস ও নামিবিয়া। পুল ‘বি’ তে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, নিউ জিল্যান্ড, কেনিয়া ও কানাডা। চার বছর আগের চেয়ে দল দুটি বাড়লেও ফরম্যাট রাখা হয় অভিন্ন। সেই দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলা, সেরা তিনটি করে দলের সুপার সিক্সে ওঠা, সেখানে গ্রুপপর্বের সঙ্গী হয়ে যাওয়া দলগুলোর বিপক্ষে পাওয়া পয়েন্ট নিয়ে যাওয়া আর অন্য গ্রুপের তিন দলের বিপক্ষে খেলা।

আফ্রিকার বিশ্বকাপ ছিল যেন অঘটনের বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তিরা। অনেক কিছুর যোগ ফলে সেমি-ফাইনালে খেলে ফেলে কেনিয়া। পূর্ণ সদস্য দেশের বাইরে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র দল হিসেবে শেষ চারে খেলে তারা। টেস্ট খেলুড়ে দেশ বাংলাদেশ হারে কেনিয়া ও কানাডার মতো দলের বিপক্ষে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বাদ পড়াটা ছিল বিস্ময়কর। বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার পর থেকেই পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত তারা। ১৯৯২ থেকে যে তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছে, প্রথম রাউন্ড পেরিয়েছে অনায়াসে। সেই দক্ষিণ আফ্রিকা ২০০৩ সালে নিজেদের মাঠের বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে বাদ!

আসলে এখানেও কাটা পড়েছে তারা দুর্ভাগ্য আর নির্বুদ্ধিতায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বৃষ্টির বাধায় পড়া শেষ ম্যাচে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান তুলে ফেলেছিল বলে ভেবেছিল তারা। ড্রেসিংরুম থেকে পাঠানো হয় তেমন বার্তাও। কিন্তু খেলা শেষে দেখা গেল, ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ম্যাচটি টাই হয়েছে কেবল। দক্ষিণ আফ্রিকার ছিটকে যাওয়ায় যথেষ্ট ছিল সেটি।

টুর্নামেন্টের চতুর্থ দিন ঘটে এই আসরের সবচেয়ে বড় অঘটন। অপেশাদারদের নিয়ে গড়া কানাডা দল হারিয়ে দেয় টেস্ট খেলুড়ে বাংলাদেশকে! ৬০ রানের হারে ঈদ মাটি হয়েছিল বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর।  

টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় হতাশার নাম ছিল পাকিস্তান। আগের আসরের রানার্সআপরা জিতেছিল কেবল নেদারল্যান্ডস ও নামিবিয়ার বিপক্ষে। হারে তিন টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ নম্বরে নেমে শোয়েব আখতার করেছিলেন সে সময়ে বিশ্বরেকর্ড ৪৩ রান।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৭ বলে তিন অঙ্ক ছুঁয়ে বিশ্বকাপের সে সময়ের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন কানাডার জন ডেভিসন। এর চারদিন আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৩৬ রানে অলআউট হয়েছিল তার দল।

টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা উদ্ভাবনী ব্যাপার ছিল রিলে থ্রো, আজকের দিনে খুব সাধারণ ব্যাপার হলেও সে সময়ে এমন কিছু ছিল অভাবনীয়। লু ভিনসেন্ট ও ক্রিস কেয়ার্নসের রিলে থ্রোয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারাকে দ্রুত ফিরিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। বিশ্বকাপের পর নেতৃত্ব হারিয়েছিলেন নাসের হুসাইন, শন পোলক, কার্ল হুপার, সনাৎ জয়াসুরিয়া, ওয়াকার ইউনুস ও খালেদ মাসুদ। 

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে বিশ্বকাপে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র ঘণ্টা প্রতি একশ মাইল বেগে বল করেন শোয়েব আখতার। তার সঙ্গে ব্রেট লির দ্বৈরথ জমে উঠেছিল দারুণ। গতির এই লড়াইয়ে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার পেসার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একশ মাইলের খুব কাছে গিয়েও তিন অঙ্ক ছুঁতে পারেননি। তবে কার্যকারিতার দিকে এগিয়ে ছিলেন তিনিই। ১০ ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ২২ উইকেট। লি রীতিমত ভয়ঙ্কর ছিলেন সুপার সিক্সে, তিন ম্যাচে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। সেমি-ফাইনাল ও ফাইনাল মিলিয়ে নিয়েছিলেন আরও পাঁচটি।

নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগের দিন বড় একটা ধাক্কা খায় অস্ট্রেলিয়া। মাদক পরীক্ষায় উতরাতে ব্যর্থ হন তাদের ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক শেন ওয়ার্ন। শুরুর আগেই টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যায় সর্বকালের সেরা এই লেগ স্পিনারের। আগের আসরের সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়কে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এলোমেলো হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পনা। পরে চোটের জন্য ছিটকে যান জেসন গিল্পেস্পি। তবে ঠিকই টানা ১১ ম্যাচ জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় রিকি পন্টিংয়ের দল।

জিম্বাবুয়ে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলে ২০০৩ আসরে জিম্বাবুয়েতে খেলতে যায়নি ইংল্যান্ড। আর নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে একই রকম সিদ্ধান্ত নেয় নিউ জিল্যান্ডও। কেনিয়ার নাইরোবিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে খেলতে যায়নি তারা। ইংল্যান্ডের জিম্বাবুয়েকে এবং নিউ জিল্যান্ডের কেনিয়াকে ওয়াকওভার দেওয়ার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বুমেরাং হয়ে সেটি ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দেয় প্রথম রাউন্ড থেকে। আর কেনিয়ার সেমি-ফাইনাল উত্তরণেও বড় ভূমিকা ছিল ওয়াকওভার ম্যাচ থেকে পাওয়া পয়েন্টের।

‘বি’ গ্রুপ থেকে সুপার সিক্সে ওঠে শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। বাদ পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কানাডা ও বাংলাদেশ। প্রথম বিশ্বকাপটা রূপকথার মতো কাটলেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ছিল দুঃস্বপ্নের সমার্থক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি ভেসে যায় বৃষ্টিতে। হারে তারা বাকি পাঁচ ম্যাচে।

‘এ’ গ্রুপ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সুপার সিক্সে উঠতে সমস্যা হয়নি বিন্দুমাত্র। ওয়ার্নকে হারানোর ধাক্কা সামলে ছয় ম্যাচের ছয়টিই জেতে তারা। পাঁচ জয়ে তাদের সঙ্গী ভারত। তৃতীয় দল হিসেবে সুপার সিক্সে যায় জিম্বাবুয়ে।

সুপার সিক্স পর্ব সবার উপরে থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া ও কেনিয়া; নিজ নিজ গ্রুপ থেকে আসা বাকি দুই দলকে হারানোয়। সুপার সিক্সে তাই একটি ম্যাচ জিতলেই সেমি-ফাইনালের হাতছানি ছিল কেনিয়ার। জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে সেই লক্ষ্যপূরণ হয় তাদের। অস্ট্রেলিয়ার জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল এখানেও। সুপার সিক্সের তিন ম্যাচই জেতে তারা। তিন ম্যাচ জেতে ভারতও। আর চতুর্থ দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে ওঠে ১৯৯৬ এর চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা। বাদ পড়ে নিউ জিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে।

সেমি-ফাইনালে কেনিয়া-রূপকথা থেমে যায় সৌরভ গাঙ্গুলী-শচীন টেন্ডুলকারের সামনে। ‘লিটল মাস্টার’ করেছিলেন ৮৩, অধিনায়ক অপরাজিত ১১১। তাতে ৫০ ওভারে চার উইকেটে ২৭০ রানে ইনিংস শেষ করে ভারত। কেনিয়া এরপর অলআউট মাত্র ১৭৯ রানে।

অন্য সেমি-ফাইনালও হয় একপেশে। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫০ ওভারে ধুঁকতে ধুঁকতে অস্ট্রেলিয়া যখন ৭ উইকেটে মোটে ২১২ রানে গিয়ে থেমে যায়, তখন এমন পূর্বাভাস করা যায়নি। তবে বল হাতে ব্রেট লি আগুন ঝরান, গ্লেন ম্যাকগ্রা বরাবরের মতো ছিলেন মিতব্যয়ী। ৩৯তম ওভারে বৃষ্টি যখন এল, লঙ্কানরা তখন সাত উইকেট হারিয়ে ১২৩ রানে। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ৪৮ রানে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া।

আর অস্ট্রেলিয়া টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতে কী রাজসিকভাবেই! জোহান্সবার্গের সেই ফাইনালে টস জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানান গাঙ্গুলী। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক পন্টিং বিস্ফোরক সেঞ্চুরিতে এক অর্ধেই এক অর্থে শেষ করে দেন খেলা। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-ম্যাথু হেইডেন মাত্র ১৪ ওভারে ১০৫ রানের ওপেনিং জুটি গড়ে দেন ভিত্তি। এরপর পন্টিং ১২১ বলে ১৪০ রানের অসাধারণ ইনিংস খেললে দুই উইকেটে ৩৫৯ রানের পাহাড় গড়ে অস্ট্রেলিয়া।

সেটি টপকানোর সাধ্য ভারতের ছিল না। প্রথম ওভারেই টেন্ডুলকার আউট হয়ে যাওয়ায় সেটি হয়ে পড়ে আরো অসম্ভব। বীরেন্দর শেবাগ (৮২) চেষ্টা করেছিলেন কিছুটা। তবু জয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি ভারত। ৩৯.১ ওভারে ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে তারা হেরে যায় ১২৫ রানের বিশাল ব্যবধানে। শিরোপার হাসিতে বাড়ির পথ ধরে প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়া।

সবচেয়ে বেশি রান:

ব্যাটসম্যান/দেশ

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

শচীন টেন্ডুলকার/ভারত

১১

৬৭৩

১৫২

৬১.১৫

১/৬

সৌরভ গাঙ্গুলী/ভারত

১১

৪৬৫

১১২*

৫৮.১২

৩/০

রকি পন্টিং/অস্ট্রেলিয়া

১১

৪১৫

১৪০*

৫১.৮৭

২/১

অ্যাডাম গিলক্রিস্ট/অস্ট্রেলিয়া

১০

৪০৮

৯৯

৪০.৮০

০/৪

হার্শেল গিবস/দক্ষিণ আফ্রিকা

৩৮৪

১৪৩

৯৬.০০

১/২

সবচেয়ে বেশি উইকেট:

বোলার/দেশ

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

চামিন্দা ভাস/শ্রীলঙ্কা

১০

২৩

৬/২৫

১৪.৩৯

৩.৭৬

ব্রেট লি/অস্ট্রেলিয়া

১০

২২

৫/৪২

১৭.৯০

৪.৭৩

গ্লেন ম্যাকগ্রা/অস্ট্রেলিয়া

১১

২১

৭/১৫

১৪.৭৬

৩.৫৬

জহির খান/ভারত

১১

১৮

৪/৪২

২০.৭৭

৪.২৩

শেন বন্ড/নিউ জিল্যান্ড

১৭

৬/২৩

১৭.৯৪

৩.৯১