অস্ট্রেলিয়ান কোচের হাত ধরে ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়

অনুশীলনে তাকে খুব ব্যস্ত বা হাঁকডাক করতে দেখা যায় খুব কমই। হয়তো রোলারের ওপর বসে থাকেন। মাঠ বা নেটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন। সংবাদমাধ্যমের সামনে হাজির হন কদাচিৎ। আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন, নিজের মতো কাজ করতে ভালোবাসেন। সেই পথ ধরে হেঁটেই ট্রেভর বেলিস পেলেন সাফল্যের ঠিকানা, ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়ের নেপথ্য নায়ক। ক্রিকেটে চিরপ্রতিন্দ্বন্দ্বী দেশ অস্ট্রেলিয়ার এই কোচের হাত ধরেই ইংলিশরা পেল বহু আরাধ্য ট্রফির দেখা।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিলন্ডন থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2019, 02:11 PM
Updated : 15 July 2019, 02:11 PM

সামনেই অ্যাশেজ, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক লড়াইয়ের উত্তেজনা হয়ে উঠবে উত্তুঙ্গ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারানোর তৃপ্তি ইংলিশদের অনেকের কাছেই বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে বড়। কিন্তু ক্রিকেট ইংলিশদের এমন বাস্তবতায় দাঁড় করাল যে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা এলো অস্ট্রেলিয়ান ছোঁয়াতেই।

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সেমি-ফাইনাল জয়ের পর ইংলিশ ক্রিকেটাররা যখন উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছেন, বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন বেলিস। এজবাস্টনে সেদিন দলের সবাইকে ডেকে নিলেন ড্রেসিং রুমে। নিজের হ্যাট খুলে শান্ত কিন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “ইংল্যান্ডের কোচ হয়ে নয়, আমি তোমাদেরকে এখন একটা কথা বলব অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে। একটা সেমি-ফাইনাল জিতেই তোমরা মনে করছো কাজ হয়ে গেছে? এখনও কিছুই জেতোনি তোমরা...।”

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা ঘটনাটি একটি নমুনা মাত্র। গত চার বছরের ধারাবাহিকতার অংশ। ইংলিশ ক্রিকেটারদের প্রতিভা, সামর্থ্য, বেলিসের পরিকল্পনা ও ম্যান-ম্যানেজমেন্টে নিজস্ব ঘরানা এবং অস্ট্রেলিয়ান মানসিকতার ছোঁয়া, সব মিলিয়েই এসেছে ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্ব শিরোপা।

বেলিসের কোচিংয়ের ধরন ও ঘরানা আর মর্গ্যানের নেতৃত্ব, দলের মানসিকতায় বদল, সব মিলিয়ে এসেছে এই সাফল্য। বেলিস বরাবরই কথা কম, কাজ বেশিতে বিশ্বাসী। তার মূল মন্ত্র, বিশ্বাস, আস্থা ও স্বাধীনতা।

যে ক্রিকেটারদের তিনি মনে করেছেন ইংল্যান্ডের জন্য সাফল্য বয়ে আনতে পারে, তাদের ওপর ভরসা করেছেন। সেই ভরসা তাদের মনেও গেঁথে দিয়েছেন। তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন নিজেকে মেলে ধরতে। ভয়ডরহীন খেলতে। বরাবরই চেয়েছেন ক্রিকেটারদের ওপর থেকে চাপ সরিয়ে তাদের মুক্ত মনে খেলতে দিতে।

ক্রিকেটারদের সঙ্গে খুব বেশি কথা অবশ্য তিনি বলেন না। তবে যেটুকু বলেন, সোজাসাপ্টা, সরল ও সরাসরি। যেটুকু দরকার। কখনোই তিনি দলের সাফল্যের কৃতিত্ব সেভাবে নিতে চাননি, ব্যর্থতার সময় দায়িত্ব নিতে পিছপা হননি। মর্গ্যান ও তার ঘরানা প্রায় এক বিন্দুতে মিলে যাওয়ায় সহজ হয়েছে কাজ।

নিজের ধরনে তিনি সফল কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। খেলোয়াড়ী জীবনে ছিলেন আগ্রাসী ব্যাটসম্যান। পরিচিত ছিলেন কাভারে দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের জন্যও। জন্ম নিউ সাউথ ওয়েলসে, অস্ট্রেলিয়ার এই রাজ্য দলটির হয়েই খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ৯৯২ রান করে রাজ্যের সেরা ক্রিকেটার মনোনীত হয়েছিলেন। তবে জাতীয় দলের কাছে সেভাবে কখনোই যেতে পারেনি। ৫৮ ম্যাচের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার শেষ হয় ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে।

এরপর তিনি নিউ সাউথ ওয়েলসের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন, কোচিং করিয়েছেন রাজ্যের দ্বিতীয় একাদশকে। ২০০৪-০৫ মৌসুমে স্টিভ রিক্সন চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব পান মূল রাজ্য দলের। সাফল্য ধরা দেয় দ্রুতই। জিতে নেন শেফিল্ড শিল্ড। পরের মৌসুমে তার কোচিংয়ে নিউ সাউথ ওয়েলস চ্যাম্পিয়ন হয় সীমিত ওভারের টুর্নামেন্টে।

২০০৭ বিশ্বকাপের পর টম মুডি শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব ছেড়ে দিলে সেই বছরই লঙ্কানদের দায়িত্ব পান বেলিস। তার কোচিংয়ে টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বরে উঠে আসে শ্রীলঙ্কা, এখনও যা লঙ্কানদের সেরা সাফল্য। ২০১১ বিশ্বকাপে তার কোচিংয়ে দল ওঠে ফাইনালে।

বিশ্বকাপের পর লঙ্কানদের দায়িত্ব ছেড়ে ফিরে যান অস্ট্রেলিয়ায়। এবারও গিয়েই পান সাফল্য। ২০১১-১২ বিগ ব্যাশে তার কোচিংয়ে শিরোপা জেতে সিডনি সিক্সার্স। আইপিএলে প্রত্যাশিত সাফল্য পেতে যখন ধুঁকছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স, বেলিস দায়িত্ব নিয়েই তাদের শিরোপা উপহার দেন ২০১২ সালে। নিউ সাউথ ওয়েলস আবার শেফিল্ড শিল্ড জেতে তার কোচিংয়ে, ২০১৩-১৪ মৌসুমে।

২০১৫ বিশ্বকাপের পর দায়িত্ব নেন ইংল্যান্ডের। পাল্টে দেন ইংল্যান্ডের ওয়ানডে দলের চিরায়ত চরিত্র। পরিণত করেন আগ্রাসী, সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত একটি জয়ী দলে। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফাইনালেও উঠেছিল ইংল্যান্ড তার কোচিংয়ে। বেন স্টোকসের চার ছক্কা হজমে সেবার শিরোপা পাওয়া হয়নি। এবার অনেক নাটকীয়তার পর সেই ইংল্যান্ড জিতল আরও বড় বিশ্বকাপ। স্টোকস হলেন নায়ক। বেলিস নেপথ্যের নায়ক। আরও একবার সফল। ক্রিকেটের কাছে ইংল্যান্ডের যেমন এটি পাওনা ছিল, বেলিসের জন্য যেন ছিল অবধারিত। সাফল্যের সঙ্গেই তো তার বসবাস!

এখন তিনি ইংল্যান্ডের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী কোচ। এবার অ্যাশেজ জিতলে, হয়তো বলতে হবে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সফলতম কোচ। তার সঙ্গে ইংল্যান্ডের চুক্তি এই অ্যাশেজ পর্যন্তই। ফাইনালের আগেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজ জিতলেও চুক্তি নবায়ন করবেন না। চার-পাঁচ বছরের বেশি টানা কোনো দলে কাজ করা তার ধরনে নেই।

এরপর জীবন তাকে যেখানেই নিয়ে যাক, ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের জায়গা পাকা করেই ফেলেছেন। ইংলিশ ক্রিকেটে অমর হয়ে থাকবেন একজন অস্ট্রেলিয়ান।