বিজয়মাল্য নিয়েই বিদায় নিলেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম অলরাউন্ডার

সাকিব আল হাসানের ওয়ানডে বিশ্বকাপ অধ্যায় এখন শেষ বলেই ধরে নেওয়া যায়, ৫০ ওভারের বিশ্ব আসরে তার চেয়ে ভালো অলরাউন্ড পারফর‌ম্যান্স নেই আর কারও।   

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিপুনে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2023, 03:00 PM
Updated : 7 Nov 2023, 03:00 PM

দিল্লি থেকে মঙ্গলবার দুপুরে দলের সঙ্গেই পুনে আসার কথা ছিল সাকিব আল হাসানের। কিন্তু দলপতি হয়ে পড়লেন দলছুট। চোট নিয়ে তাকে ফিরতে হলো। দুপুরে দিল্লি বিমাবন্দরে তাকে দেখা গেল, গলার সঙ্গে হাত ঝোলানো স্লিংয়ে। বাঁহাতের তর্জনি ও মধ্যাঙ্গুলি একসঙ্গে জুড়ে ব্যান্ডেজ করা।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে চোট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছেন সাকিব। বাংলাদেশ অধিনায়ক খেলতে পারবেন না অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আগামী শনিবারের ম্যাচে। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার আর কতটা দীর্ঘায়িত হবে, সিদ্ধান্ত নেবেন তিনিই। তবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ অধ্যায় তার শেষ হয়ে গেল প্রায় নিশ্চিতভাবেই। শেষটায় তিনি বিশ্বকাপের দেশ ছেড়ে গেলেন স্লিঙে হাত ঝুলিয়ে। কিন্তু অদৃশ্য একটি মালাও কি গলায় ছিল না? বিজয়ের মালা!

বিশ্বকাপে তার শেষ ম্যাচটিতে দল জিতেছে। সেই জয়ের নায়ক তিনি। ম্যাচ সেরার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সামগ্রিকভাবে যদিও দলের বিশ্বকাপ চরম হতাশাময়। তিনি নিজেও এই ম্যাচের আগ পর্যন্ত ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। শেষ ম্যাচটি ব্যাটে-বলে রাঙিয়েছেন বটে। তবে তার বিজয়মাল্য আসলে এক ম্যাচ বা এক বিশ্বকাপের নয়। সব আসর মিলিয়েই তিনি সেরা।

রেকর্ড বই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, ওয়ানডের বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্বের আসরের ইতিহাসে সাকিবই শ্রেষ্ঠতম অলরাউন্ডার।

এখনও তিনি অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেননি যে আর বিশ্বকাপ খেলবেন না। তবে বাস্তবতা বলছে, এটিই শেষ। দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ২০২৭ বিশ্বকাপের সময় তার বয়স হবে ৪০। ওই বয়সে খেলা অসম্ভব নয়। তবে সাকিবের নানা বান্তবতায় সম্ভাবনা সামান্যতমও আছে বলে মনে হয় না।

এবার বিশ্বকাপের আগে টি-স্পোর্টসে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে বিদায় জানাতে চান ওয়ানডে ক্রিকেটকে। বাংলাদেশ যদি শেষ পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করেও ভাববেন। সম্ভাব্য সব চিত্র মিলিয়েই তাই বলা যায়, ওয়ানডে বিশ্বকাপের মঞ্চে সাকিবের শেষ প্রদর্শনী আমরা দেখে ফেলেছি।

শেষটা দিয়েই শুরু করা যাক। দিল্লিতে সোমবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে আগে তার পারফরম্যান্স ছিল একদম হতশ্রী। দলের সেমি-ফাইনাল খেলার স্বপ্ন হয়ে উঠেছে উপহাসের উপলক্ষ। পারফরম্যান্স আর নেতৃত্বের দীনতায় কাঠগড়ায় অধিনায়কও। অন্ধের যষ্টি কেবল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা। সেটিও ঝুলছিল সুতোয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের বিকল্প ছিল না।

ক্যারিয়ারে অসংখ্যবারের মতো আরও একবার কাক্ষিত সেই জয়টি ধরা দিল সাকিবের হাত ধরেই। বোলিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট, ব্যাট হাতে ৬৫ বলে ৮২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস। গত সাত বছরের মধ্যে ফিফটি ছোঁয়া ইনিংসে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট। দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের আলোয় দলে হারের আঁধার কাটান তিনি। কিংবা তার শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ বলে ক্রিকেটই সব আয়োজন করে রেখেছিল!

বিশ্বকাপের মঞ্চ যেমন তিনি রাঙিয়েছেন নানা রঙে, তার শেষটা তো আর এতটা বিবর্ণ হতে পারে না!

তার দল এখন চেষ্টা করছে তলানির সেরা হতে, বিশ্ব আসরে বেশির ভাগ সময় তাদেরকে থাকতে হয় তলানির দিকেই, তবে তিনি নিজে বিশ্বকাপের সেরাদের সেরা!

সেই ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচেই স্মরণীয় এক জয়ের নায়কদের একজন ছিলেন সাকিব। ভারতের বিপক্ষে সেদিন আঁটসাঁট বোলিংয়ের পর উপহার দিয়েছিলেন দারুণ এক ফিফটি। সেদিনের সেই টিনএজ প্রতিভা ক্রমে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ভরসা, বছর দুয়েক পরই শীর্ষে উঠেছেন আইসিসি ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়ে, সাফল্যের পথ ধরে উঠেছেন টেস্ট অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়েরও এক নম্বরে, বছরের পর বছর ধরে রেখেছেন র‌্যাঙ্কিংয়ে দাপট, হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম বিজ্ঞাপন, এদেশের প্রথম বিশ্ব তারকা এবং মাতিয়েছেন বিশ্ব আসরও।

এখন যখন তার বিশ্বকাপ অধ্যায়ের যবানিকা ধরেই নেওয়া যায়, তার রেকর্ডই জ্বলজ্বল করে ফুটিয়ে তুলছে তার বীরবত্বগাঁথা।

৩৬ ম্যাচ খেলে ৪১.৬২ গড়ে ১ হাজার ৩৩২ রান তার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল ছয় ব্যাটসম্যান। বল হাতে উইকেট ৪৩টি। বাঁহাতি স্পিনে তিনিই সেরা। সব মিলিয়ে তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন কেবল ১০ জন বোলার।

এমন রেকর্ডের যে কোনো একটি থাকলেই বর্তে যেতে পারেন কত কত ক্রিকেটার! সাকিব করেছেন দুটিই। ব্যাট-বলে সাফল্যের এমন যুগলবন্দিতে তিনি বিশ্বকাপ ইতিহাসে অনন্য। একমাত্র। অবিসংবাদিত।

বিশ্বকাপে অন্তত ১ হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ৩০ উইকেটও নেই আর কারও। বিশ্বকাপে ৩০ উইকেট শিকারি বোলারদের মধ্যে ৭০০ রানও নেই অন্য কারও।

ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনি চার বার। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আর কেউ দুবারের বেশি সেরা হতে পারেননি। সাচিন টেন্ডুলকারের মতো ৯ বার সেরা তিনি হতে পারেননি বটে। তবে ঠিকই স্পর্শ করেছেন ভিরাট কোহলি, সৌরভ গাঙ্গুলি, ব্রায়ান লারা, শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়াহ, আরাভিন্দা ডি সিলভা, ডেভিড বুন, কুমার সাঙ্গাকারা, ইউভরাজ সিং, মাহেলা জায়াওয়ার্দেনের মতো তারকাদের।

যদিও প্রথম তিন বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স অনেকটাই ছিল সাদামাটা। প্রথম বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অভিষেকে ওই ফিফটির পর আরেকটি পঞ্চাশের স্বাদ পান ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বকাপে তিনিই অধিনায়ক। বিতর্কে ভরা সেই আসরে আবারও প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ফিফটির পর আর পঞ্চাশ ছুঁতে পারেননি একবারও।

অস্ট্রেলিয়ায় পরের আসরের শুরুটা দারুণ করেন। যথারীতি প্রথম ম্যাচে অর্ধশতক উপহার দেন আবার। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করেন ৪৬, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ফিফটি। কিন্তু শেষ তিন ম্যাচে পারেননি ভালো করতে।

এক দশক ধরে অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ের রাজা হয়ে থাকা ক্রিকেটার অবশেষে বিশ্বকাপ রাজত্ব করেন ২০১৯ আসরে। সেই বিশ্বকাপে দৃষ্টি রেখে আইপিএলের সময় ফিটনেস নিয়ে কাজ করেন আলাদাভাবে। দেশ থেকে নিজের শৈশবের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে নিয়ে গিয়ে নিবিড়ভাবে স্কিল ঝালাই করেন। ওজন অনেক কমিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে ওঠেন। বিশ্বকাপের আগে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেন, একটা ‘কিক’ পেয়েছেন, যে কারণে এবার বিশ্বকাপে ভালো করতে তিনি মরিয়া।

সেই পরিশ্রম আর প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন পড়ে তার পারফরম্যান্সে। দল হতাশ করলেও ম্যাচের পর ম্যাচে অসাধারণ পারফর‌ম্যান্স মেলে ধরেন তিনি। আপন পরিচয়েই তিনি পরিচিত ছিলেন, তবু সেবার বিশ্ব ক্রিকেট তাকে চেনে নতুন করে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরের সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখান তিনি। ৬০৬ রান ও ১১  উইকেট- এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আগে কখনোই কারও কাছ থেকে দেখেনি বিশ্বকাপ ক্রিকেট।

এই বিশ্বকাপ দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার জনপ্রিয়তা পৌঁছে যায় ভিন্ন উচ্চতায়। বিশ্ব ক্রিকেটেও কুলীনদের কাছে উপযুক্ত কদর পেতে থাকেন তিনি।

এই ৩৬ বছর বয়সে এবারের বিশ্বকাপে গতবারের মতো পারফরম্যান্সের প্রত্যাশা তার কাছে ছিল না। তবু ভালো কিছুর আশা তো ছিলই। বিশেষ করে, ১২ বছর পর আবার অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ অভিযান তার। স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। কিন্তু সব মিশে গেছে ধুলোয়। বিশ্বকাপের আগে নানা বিতর্ক হয় দল ঘিরে, একটি সাক্ষাৎকার ঘিরে তিনি নিজেও বিতর্কের কেন্দ্রে ঢুকে যান। সেটির প্রভাবেই হোক বা অন্যান্য কারণে, হতাশার চূড়ান্ত উপহার দিয়েছে দল, অচেনা রয়ে গেছেন তিনি।

অবশেষে… শেষ বেলায় এসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দেখা গেল সেই চেনা সাকিবকে। যদিও নিজেকে জানান দিতে এবার দেরি করে ফেললেন অনেক, তবু শেষবেলায় ঠিকই দ্যুতি ছড়ালেন। একটু ঝিলিক দেখালেন, কেন তিনি বিশ্বকাপের সেরা।

পরের বিশ্বকাপে হয়তো তিনি থাকবেন না ক্রিকেটার হিসেবে, তবে থাকবে তার কীর্তি। তার সৌজন্যে থাকবে তার দেশও। বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত বলার মতো কিছু করতে পারেনি বাংলাদেশ। দলীয় বড় কিছু অর্জনের আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপে অন্তত একটি গৌরবের জায়গা থাকবে এই দেশের, ‘সাকিব।’