দেশের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে না পারার কষ্ট অনেকদিন পুড়িয়েছে তাকে, সেই তিনি এখন অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের দুয়ারে।
Published : 18 Nov 2023, 09:15 PM
জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন, অনেক অনেক প্রশ্ন, বড় বড় উত্তর। সব মিলিয়ে ৩৪ মিনিটের সংবাদ সম্মেলন। প্রত্যাশার চাপ, দলের ভেতরের আবহ, অস্থিরতা, আবেগ-উত্তেজনা, এসব নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছুটে গেল রোহিত শার্মার দিকে। ভারতীয় অধিনায়ক বারবারই বললেন, দলকে এসব স্পর্শ করছে না এবং তারা স্থির আছেন। কেবল শেষ পর্যায়ে একটি প্রশ্নে আবেগ একটু ফুটে উঠল তার কথায়, হাসিতে আর মুখভঙ্গিতে। যখন ১২ বছর আগে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার প্রসঙ্গ এলো!
২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের বিশ্বজয়ের অংশ হতে পারেননি তিনি। বিশ্বকাপ দলে যে জায়গাই পাননি! ব্যাট হাতে খুব একটা ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না সেই সময়। তবে স্কোয়াডে নিয়মিতই ছিলেন। বিশ্বকাপ দলেও থাকবেন বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশের মাঠে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি।
এই তো, কিছুদিন আগে সেই সময়ের এক নির্বাচক জানিয়েছেন যে, দল নির্বাচনী সভায় শেষ পর্যন্ত এসে ঠেকেছিল যে, রোহিত নাকি পিয়ুস চাওলা। অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনি চাচ্ছিলেন একজন বাড়তি স্পিনার। মূলত তার চাওয়াতেই রোহিত সুযোগ না পেয়ে লেগ স্পিনার পিয়ুসকে নেওয়া হয়।
রোহিত তখন অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। নিজেকে গোছাতে তার সময় লেগেছে। সেই দুঃসময়ের কথা তিনি বলেছেন অনেক। কতটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, নানা সময়েই বলেছেন তা। তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিভীষিকার সময় হয়তো সেটিই।
পরের গল্পটাও জানা প্রায় সবার। রোহিতের ক্যারিয়ার নতুন মাত্রা পায় ধোনির একটি সিদ্ধান্তেই। ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রোহিতকে ওপেনিংয়ে তুলে আনেন ধোনি। তার পারফরম্যান্স সেই টুর্নামেন্ট থেকেই পৌঁছে যায় নতুন উচ্চতায়। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি, অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা, সব মিলিয়ে ওয়ানডে ব্যাটিং নতুন মাত্রা পায় তার হাত ধরে।
প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন ২০১৫ আসরে। কোয়ার্টার-ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে তো রেকর্ডের মালা গেঁথে সেঞ্চুরি করতে থাকেন। এক আসরেই করেন ৫ সেঞ্চুরি!
আইপিএলে ততদিনে নেতৃত্বেও দারুণ সফল তিনি। তবে জাতীয় দলের নিয়মিত অধিনায়ক হওয়ার সময় অনেকটাই পেরিয়ে গিয়েছিল বলেই মনে হচ্ছিল। ধোনির হাত থেকে ভারতীয় দলের দায়িত্ব পান ভিরাট কোহলি। বয়সে তিনি রোহিতের ছোট।
নানা সময়ে কোহলির অনুপস্থিতিতে অবশ্য সফলভাবেই দায়িত্ব চালিয়ে নেন তিনি। ২০১৮ নিদাহাস টি-টোয়েন্টি ট্রফি বা ওই বছরের এশিয়া কাপে তার নেতৃত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। তবে নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে ভাবনায় ছিলেন না তিনি। তার নিজেরও তেমন ইচ্ছে ছিল না বলেই জানা যায়।
এরপর তো ভারতীয় বোর্ডের সেই সময়ের প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে কোহলির সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং কোহলির নেতৃত্বের অধ্যায়ের নাটকীয় অবসান। রোহিত সেসময়ও অধিনায়কত্ব নিতে রাজি ছিলেন না বলেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। পরে সৌরভের চাপাচাপিতে দায়িত্ব নিয়ে নেন, এরকমও শোনা যায়।
সেই রোহিত, ১২ বছর আগে দেশের মাঠে বিশ্বকাপ খেলতে না পারা তরুণ ব্যাটসম্যান, অধিনায়কত্ব নিতে না চাওয়া অভিজ্ঞ ক্রিকেটার, এখন তার দুর্দান্ত নেতৃত্বেই আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের দুয়ারে ভারত।
সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া বলতে যা বোঝায়, এই বিশ্বকাপে সেসবের চূড়ান্ত করে চলেছেন রোহিত। ১০ ইনিংসে ৫৫ গড়ে ৫৫০ রান করেছেন। অধিনায়ক হিসেবে এক আসরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। তবে এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, নিজের ব্যাটিংকে ভেঙে গড়েছেন এই ৩৬ বছর বয়সে এসে।
যে রোহিত ‘হিটম্যান’ নামে পরিচিত, তিনি আসলে বেশির ভাগ সময়ই শুরুতে একটু সময় নিয়ে ইনিংস গড়ে থিতু হওয়ার পর ছক্কার ঝড় বইয়ে দিতেন। কিন্তু এই বিশ্বকাপে রোহিত খেলছেন ভিন্ন ভূমিকায়, যিনি প্রথম ওভার থেকেই প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর ছড়ি ঘোরান। দল থেকে এই ভূমিকা তাকে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি দারুণভাবে তা পালন করে চলেছেন।
ম্যাচের পর ম্যাচ শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের সেরা বোলার, নতুন বলের বোলারদের ওপর চড়াও হচ্ছেন তিনি। এতে দলের রান বাড়ছে দ্রুত, প্রতিপক্ষ ম্যাচের শুরুতেই চলে যাচ্ছে পেছনে। অন্য ওপেনার শুবমান গিল ইনিংস গড়ছেন পরিস্থিতি বুঝে। রোহিতের উড়ন্ত সূচনার পর ভিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার ও লোকেশ রাহুলরা বাকি কাজ সারছেন।
দলকে গতিময় শুরু এনে দিতে গিয়ে অনেক ঝুঁকি নিতে হচ্ছে রোহিতকে। বড় ইনিংসের সংখ্যা তাই কমে গেছে। দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরির পর বিশ্বকাপে এবার আর তিন অঙ্কে যেতে পারেননি তিনি। তবে রান ঠিকই করছেন। কার্যকর ও প্রভাববিস্তারি রান। এই বিশ্বকাপে তার স্ট্রাইক রেট ১২৪.১৫। এবারের আসরে ৪০০ রান ছোঁয়া অন্য ১০ ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট রোহিতের কাছাকাছিও নেই।
দলের জন্য এই যে ত্যাগ বা ঝুঁকির পথে হাঁটা বুকে সাহস নিয়ে, এটাই তো সত্যিকারের নেতার লক্ষণ!
মাঠের ভেতরে নেতৃত্বের বিভিন্ন সিদ্ধান্তেও তাকে দেখা গেছে বেশ কুশলী। আগের চেয়ে মাঠে অনেক সক্রিয়ও থাকেন। ভিরাট কোহলির মতো মাঠে তিনি খুব উচ্চকিত, সরব নন, তেড়েফুঁড়ে কিছু করেন না। মাহেন্দ্র সিং ধোনির মতো অবিশ্বাস্য শীতলতায় কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতাও হয়তো তার নেই। তবে দুজনের সম্মিলনে ভিন্ন একটি ঘরানা তিনি তৈরি করতে পেরেছেন এবং এই বিশ্বকাপে নেতৃত্বে নিজের ছাপ রাখতে পেরেছেন।
মাঠের বাইরেও দলকে এককাট্টা করে তোলায় তার ভূমিকা নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে এখন চর্চা হচ্ছে দারুণ। কোহলির সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে আগে অনেক আলোচনা হলেও এখন দুজনের সম্পর্কের উন্নতির ছাপ এই বিশ্বকাপেই দেখা গেছে বারবার। ক্রিকেটারদের সম্পর্কের বন্ধন আরও পোক্ত করতে বিভিন্ন ধরনের মজার আয়োজন করেন দলের ভেতর। সেমি-ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে যেমন বলেছেন, দলের ভেতর ফ্যাশন শো আয়োজন করা হয়েছিল। সেসবের বিস্তারিত যদিও বলেননি। তবে বারবারই বলেছেন, দলটাকে একটা সুখি পরিবারে রূপ দিতে সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছেন তিনি ও টিম ম্যানেজমেন্টের অন্যরা।
এই সুখের আবহেই ১২ বছর আগের কষ্ট চাপা দিয়েছেন তিনি। ওই সময়টার কথা ভেবে হৃদয়ে বেদনা জাগাতে চান না বলেই জানালেন ফাইনালের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে।
“আমি আর ওই সময়টায় ফিরে যেতে চাই না। খুবই আবেগময় সময় ছিল আমার জন্য। এখন তো এটা সবারই জানা। খুব কঠিন সময় ছিল। তবে এখন আমি খুবই খুশি যে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি, বিশ্বকাপের ফাইনালে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। কখনোই ভাবতে পারিনি, এরকম কিছু হবে। তবে কিছু চাইলে সত্যিই তা হয়।”
“এই পর্যায়ে আসতে পেরে আমি তাই খুবই খুশি। তবে কালকের দিনটির গুরুত্ব আমি জানি। তাই সবকিছু স্বাভাবিক, স্থির ও শান্ত রাখতে চাই। ২০১১ সালে কী হয়েছিল বা কালকে কী হতে পারে, এসব ভাবনায় আবেগপ্রবণ হতে চাই না। বিশ্বকাপ শুরুর সময় যে আবহ ছিল, ফাইনালেও তা গড়তে চাই। দলের সবাই খুব ভালো জায়গায় আছি এখন। এটাকেই স্রেফ ধরে রাখতে হবে। খুব বেশি উত্তেজিত হতে চাই না, বেশি মিইয়েও থাকতে চাই না। ভালোভাবে সমন্বয় করতে চাই।”
তিনি সেই সময়ে ফিরে যেতে না চাইলেও মনের কোনো এক কোণে নিশ্চয়ই পড়ে আছে তা। মাঝেমধ্যে কাঁটা হয়ে বিদ্ধও হয়তো করে। তবে এবার যদি বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারেন তিনি, সেই কাঁটাও হয়তো সরে যাবে, চিরদিনের মতো।