পুরকৌশল পড়ে চাকরি ছেড়ে টেনিস বল থেকে আইপিএলে রেকর্ড গড়ার নায়ক

২৪ বছর বয়স পর্যন্ত টেনিস বলে খেলতেন, প্রকৌশলী হিসেবে শুরু করেছিলেন চাকরি, সেই তিনি এখন ২৯ বছর বয়সে আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের নায়ক। আকাশ মাধওয়ালের গল্পটা রূপকথা নয়, বরং পরিশ্রম ও স্বপ্নের জয়।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2023, 05:12 AM
Updated : 25 May 2023, 05:12 AM

ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে বললেন, “সবাই বলে, আকাশ মাধওয়াল নাকি খুব দ্রুত শিখতে পারে…!” মুচকি হাসিতে আকাশ মাধওয়ালের ত্বরিত জবাব, “প্রকৌশলীদের তো এক ধরনের প্রবণতা থাকে… দ্রুত শেখার ক্ষমতা থাকে!” কথা শেষ হওয়ার আগেই হার্শা হাসিমুখে বললেন, “প্রকৌশলীদের কথা বললেন, খুব ভালো লাগল…।”

হার্শা নিজেও ছিলেন প্রকৌশলী। তবে তার ভালোবাসা ছিল ক্রিকেট। ক্রিকেটার হতে পারেননি, অনেক সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ক্রমে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকদের একজন। আকাশ মাধওয়ালও একই পথের পথিক। ধারাভাষ্যে নয়, তিনি আছেন ২২ গজের মূল স্রোতেই। প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াশোনা করে চাকরিও শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার প্রেম তো ক্রিকেট! উত্তরাখন্ডের টেনিস বলের ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়াতেন। একসময় তার প্রেমেরই জয় হলো। চাকরির নির্ভরতা ছেড়ে হাঁটা শুরু করলেন ক্রিকেটের অনিশ্চিত পথে। ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত স্রেফ টেনিস বলে খেলা সেই মানুষটিই আজ আইপিএলে  রেকর্ড গড়া বোলার, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের মতো দলকে ফাইনালের লড়াইয়ে রাখার নায়ক ও এখন আইপিএলের আলোচিত চরিত্র।

আকাশ মাধওয়ালের গল্পটা রূপকথার মতো। তবে রূপকথা আসলে নয়। অনেক ঘাম ঝরিয়ে, অনেক পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে, আবেগকে পুঁজি করে স্বপ্নকে তাড়া করে অবশষে সফল হওয়ার গল্প। এই ২৯ বছর বয়সে আইপিএলে অভিষেক, পারফর্ম করা এবং এই বয়সে এসে ভারতীয় ক্রিকেটে নিজেকে চেনাতে পারা… সব মিলিয়ে নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণের আখ্যান।   

আইপিএলের এলিমিনেটর ম্যাচে বুধবার এই আকাশ গুঁড়িয়ে দেন লক্ষ্নৌ সুপার জায়ান্টসকে। তার বোলিং ফিগার এ দিন অবিশ্বাস্য, ৩.৩-০-৫-৫!

আইপিএলে সব আসর মিলিয়ে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেন তিনি এই ম্যাচে (৫ রানে ৫ উইকেট ছিল অনিল কুম্বলেরও)। তার চেয়ে কম রানে ৫ উইকেট নিতে পারেননি ভারতীয় বা বিদেশি মিলিয়ে আর কেউ। প্লে অফ ম্যাচে ৫ উইকেট শিকারের প্রথম কীর্তিও তারই। 

ঠিক আগের ম্যাচেই গত রোববার মুম্বাইকে প্লে অফের লড়াইয়ে টিকিয়ে রাখার ম্যাচে তিনি নিয়েছিলেন ৪ উইকেট।

সব মিলিয়ে গত চার ম্যাচে তার প্রাপ্তি ১২ উইকেট। আইপিএলের এবারের আসরের শেষ সময়ের দমকা হাওয়া তিনি। যে হাওয়া নাড়িয়ে দিয়েছে সবাইকেই। সবার আগ্রহ ও কৌতূহলের কেন্দ্রেও এখন তিনি। প্রকাশ্যে আসছে ক্রিকেটের পথে তার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞতায় ছুটে চলার গল্প।

গত দুই মৌসুমে মুম্বাইয়ের নেট বোলার ছিলেন তিনি। এর আগে এক মৌসুমে নেট বোলার ছিলেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালোরে। আরেকটু আগে, এই ২০১৯ সালেও তিনি ছিলেন মূলত টেনিস বলের ক্রিকেটার!

উত্তর প্রদেশের ডুংরায় জন্ম আকাশের। তার বাবা ঘনা নন্দ কাজ করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে। বাবার চাকরির সুবাদেই তারা থিতু হন উত্তর প্রদেশের রুর্কিতে। সেখানেই আকাশ ও তার ভাই আশিষ ক্রিকেট শুরু করেন। একটি একাডেমিতেও নাম লেখান আকাশ। তবে মূলত টেনিস বলেই খেলে বেড়াতেন তিনি উত্তরাখন্ডের গোটা পশ্চিমাঞ্চলে। 

রুর্কিতে আকাশদের প্রতিবেশি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের এই সময়ের বড় তারকা রিশাভ পান্ত। দুজনের শৈশবের কোচও একজনই।

২০১০ সালে আকাশের বাবা মারা যান ৫৭ বছর বয়সে। পরিবারে আকাশ ভেঙে পড়ে। গৃহিনী মা সংসার সামলাতে হিমশিম খেতে থাকেন। আকাশের বয়স তখন সবে ১৭ হতে চলেছে।

খেলার পাশাপাশি পড়াশোনায়ও ভালো ছিলেন আকাশ। অনেক কষ্ট সয়ে রুর্কি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পুরকৌশলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করেন। পরিবারের কষ্টের দিন শেষ হলো বলে। কিন্তু আকাশের মাথায় যে ক্রিকেটের পোকা!

টেনিস বলে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ভারতীয় বোর্ড বিসিসিআইয়ের স্বীকৃতি পেল উত্তরাখন্ড। আকাশ তখন ক্রিকেট নিয়ে প্রবলভাবে ভাবতে শুরু করলেন। উত্তরাখন্ডের হয়ে খেলার স্বপ্নে ক্রিকেট বলে অনুশীলনও চালাতে থাকলেন। ২০১৯ সালে উত্তরাখন্ডের একটি ট্রায়ালে তিনি নজর কাড়লেন সেই সময়ের কোচ ওয়াসিম জাফরের।

জাফর তার দিকে আলাদা মনোযোগ দিলেন। উত্তরাখন্ডের ক্রিকেট প্রশাসনের কর্তারাও তার মধ্যে দেখলেন বিশেষ কিছু। টেনিস বলে খেলার কারণে ইয়র্কার রপ্ত করেছিলেন তিনি দারুণভাবে। সঙ্গে ক্রিকেট বলে তার কিছু সহজাত স্কিলও দেখা গেল। শুরু হলো তাকে ঘষেমেজে তৈরি করার অভিযান। ২০১৯ সালেই সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফি দিয়ে তার টি-টোয়েন্টি অভিষেক। কদিন পর রঞ্জি খেলতেও নেমে গেলেন।

তবে আকাশের মূল উন্নতির শুরু ২০২০-২১ মৌসুমে। স্কিল অনেক বেশি বলে তিনি ম্যাচেও অনেক কিছু চেষ্টা করতেন। তাতে বোলিংয়ের ধারাবাহিকতা হারিয়ে যেত প্রায়ই। ওই মৌসুমে তার মানসিক দিকগুলো নিয়ে কাজ শুরু করলেন উত্তরাখন্ডের সেই সময়ের কোচ মনিশ ঝা।

এক পর্যায়ে উত্তরাখন্ডের কর্তারা উপলব্ধি করতে পারলেন, বড় ভার পেলে হয়তো আরেকটু দায়িত্ব নিয়ে বোলিং করবেন আকাশ। তাকে উত্তরাখন্ডের টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক করা হলো। তিনিও বুঝতে পারলেন, মাঠে নেমে নিজের সব স্কিল মেলে ধরার চেষ্টা করাই সবকিছু নয়, বরং পরিস্থিতি বুঝে বল করাই গুরুত্বপূর্ণ। বোলিংয়েও সেই ভাবনার প্রকাশ পড়তে থাকল।

আইপিএলের সঙ্গে তার পরিচয় অবশ্য এর আগেই। ২০১৯ সালে বেঙ্গালোরের নেট বোলার ছিলেন তিনি। তার ওপর নজর ছিল মুম্বাইয়ের স্কাউটদের। ২০২১ সালে তাকে আনা হলো মুম্বাইয়ের নেট বোলার হিসেবে। গত মৌসুমেও সেই সাপোর্ট বোলারদের মধ্যে রাখা হলো তাকে। নেটে এবং প্রস্তুতি ম্যাচগুলিতে ভালো খেলে নজর কাড়লেন। গত মৌসুমের শেষ দিকে যখন সূর্যকুমার যাদব চোটে পড়লেন, তার বদলে আকাশকেই মূল দলে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।

জন্ম হলো নতুন ইতিহাসের। উত্তরাখন্ডের প্রথম আইপিএল ক্রিকেটার!

গত আসরে একাদশে সুযোগ পাননি। এবার নিলামে ২০ লাখ রুপিতে দলে নিয়ে তাকে মূল স্কোয়াডেই অন্তর্ভুক্ত করে মুম্বাই। তবে যথারীতি সুযোগ মেলেনি প্রথম এক মাসে। তবে চোটের কারণে জাসপ্রিত বুমরাহর না থাকা ও টুর্নামেন্ট চলার সময় জফ্রা আর্চার ছিটকে পড়ায় ডেথ ওভারের জন্য উপযুক্ত পেসার প্রয়োজন ছিল মুম্বাইয়ের। অধিনায়ক রোহিত শর্মার মনে পড়ল আকাশের কথা। অবশেষে সেই সময়টা এলো। গত ৩ মে তার আইপিএল অভিষেক।

পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে সেদিন ৩ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন আকাশ। দল আস্থা হারায়নি। পরের ম্যাচে প্রথম আইপিএল উইকেটের স্বাদ পান তিনি ডেভন কনওয়েকে ফিরিয়ে। পরের ম্যাচে আবার খরুচে বোলিংয়ে উইকেটশূন্য। তবু মুম্বাই তাকে ধরে রাখল একাদশে। তিনিও প্রতিদান দিলেন। সবশেষ ৪ ম্যাচে তার উইকেট ১২টি। এলিমিনেটর ম্যাচে একগাদা রেকর্ড। তার দুর্দান্ত বোলিংয়েই এখন ফাইনালের লড়াইয়ে টিকে আছে দল।

মুম্বাইয়ের নেট বোলার থাকার দিনগুলিতেই ইয়র্কার স্পেশালিস্ট হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। এখন আইপিএলে ৭ ম্যাচ খেলেও ইয়র্কারে সেই দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। এলিমিনেটর ম্যাচের পর আকাশ জানালেন, টেনিস বল থেকেই তার ইয়র্কার এই শিক্ষা।

"টেনিস বলে তো স্রেফ ইয়র্কারই শিখেছি। কারণ ওখানে বাঁচার উপায় একটিই। একটু সামনে বা পেছনে থাকলেই তো ছক্কা হয়ে যায়। টেনিস বলে তাই ইয়র্কার নিখুঁত হতে হয়। সেটিই আমি এখানে নিয়ে এসেছি।”

“অনুশীলন করি প্রচুর (ইয়র্কারের), সেটিই এখন কাজে দিচ্ছে। নেটে অনুশীলন করি, কোচ-ম্যানেজমেন্ট সহায়তা করে, তারা যেভাবে চায়, সেভাবে অনুশীলন করে সফল হচ্ছি।”

সবশেষ ম্যাচগুলিতে যেভাবে বোলিং করেছেন আকাশ, তাতে অনেকটাই পূরণ করেছেন ডেথ ওভারে জাসপ্রিত বুমরাহর ঘাটতি। যদিও এই প্রসঙ্গ উঠতেই অস্বস্তি নিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলেন তিনি।  

“বুমরাহ ভাই তার জায়গায় আছেন, আমি নিজের জায়গায়। এমন নয় যে বুমরাহ ভাইয়ের জায়গা নিয়ে নিচ্ছি। তবে আমার যতটুকু করার, আমি দলের জন্য করছি। দল যে ভূমিকা দিয়েছে, তা পালন করার চেষ্টা করছি। সেই চেষ্টাই করে যাব।”

ভবিষ্যতে বুমরাহ ফিরবেন, আর্চার হয়তো ফিরবেন। মুম্বাইয়ের মতো দলে জায়গা করে নিতে মুখিয়ে থাকবেন আরও অনেক পেসার। তবে আকাশও হয়তো নিজের আকাশের সীমানা বাড়াতে থাকবেন!

সেই সামর্থ্য তিনি দেখিয়েছেন। অনেক লড়াই করে ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই ২৯ বছর বয়সে। নিজের সংগ্রামমুখর জীবনটাই তার এগিয়ে চলার প্রেরণা।

“আমি স্রেফ অনুশীলন করছিলাম এবং এই সুযোগের খুব অপেক্ষায় ছিলাম। শুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছি, এরপর প্যাশনকে অনুসরণ করেছি। টেনিস বলে খেলতাম… ২০১৮ সালে যখন উত্তরাখন্ডের অন্তর্ভুক্তি হয়, এরপর ক্রিকেটকে আপন করে নিয়ে ঘাম ঝরিয়ে এগিয়েছি।”

“সময়টা এখন আমি খুব উপভোগ করছি, কারণ অনেক কষ্ট করে ক্রিকেটে টিকে আছি। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে, চাকরি ছেড়ে নিজের প্যাশনকে আঁকড়ে ধরেছি, বাড়িতে তেমন কিছু নেই… প্যাশনকে উপভোগ করলে লোকে ফুরফুরে থাকে, মজায় থাকে। আমার ওপর কোনো চাপ নেই যে ক্রিকেট খেলতেই হবে। আমার প্যাশন ছিল বলেই খেলছি।”

এলিমিনেটর ম্যাচে এত এত রেকর্ডের কথা যখন বলা হলো, তাতে নিজের পরিশ্রমের ফসল দেখতে পেলেন আকাশ। তবে স্বপ্ন তার আরও অনেক কিছু করার।

“নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে… তবে চেষ্টা করব এর চেয়েও ভালো কিছু করার। পরের ম্যাচগুলিতে ভালো করতে চাইব, দলকে চ্যাম্পিয়ন করার চেষ্টা করব… আরও ভালো কিছু করতে চাইব।”

হার্শা ভোগলে ম্যাচ শেষে আকাশকে উপাধি দিলেন, ‘উত্তরাখন্ডের শাহেনশাহ।’ তাতে খানিকটা লজ্জাই পেয়ে গেলেন আকাশ। তবে নিজের জগতে তিনি তো এখন শাহেনশাহ বটেই! অনেকের জন্য প্রেরণার প্রতিশব্দও।