ব্যাটিং ব্যর্থতায় শেষ ম্যাচে পেরে উঠল না বাংলাদেশ, মিচেল স্যান্টনারের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সিরিজ ড্র করল নিউ জিল্যান্ড।
Published : 31 Dec 2023, 08:44 AM
‘এই মাঠে প্রথম ইনিংসের গড় রান ১৯৮। আজকেও উইকেট ব্যাটিং সহায়ক, প্রচুর রান আছে এখানে’- ম্যাচের আগে পিচ রিপোর্টে বেশ জোর দিয়েই বললেন ধারাভাষ্যকার ক্রেইগ ম্যাকমিলান। সাবেক নিউ জিল্যান্ড ব্যাটসম্যানের কথাগুলি ম্যাচ শেষে মনে হচ্ছিল যেন প্রহসন! দুই দলের ব্যাটিংই যে একরকম মুখ থুবড়ে পড়ল এখানে। ছোট্ট পুঁজি নিয়েও নিউ জিল্যান্ডের ঘাম ছুটিয়ে ছাড়ল বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে জয় পেল কিউইরাই।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে শেষ টি-টোয়েন্টিতে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে ১৭ রানে হারাল নিউ জিল্যান্ড। তিন ম্যাচের সিরিজ শেষ হলো ১-১ ড্রয়ে।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে জিতেছিল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচ পরিত্যক্ত হয় বৃষ্টিতে।
বে ওভালের উইকেট এ দিন ছিল কিছুটা মন্থর। উইকেট যে ভালোভাবেই পড়তে পেরেছিল বাংলাদেশ, সেটির প্রমাণ একাদশেই। পেসার তানজিম হাসানের বদলে স্পিনার তানভির ইসলামকে এনে তিন জন বিশেষজ্ঞ স্পিনার নিয়ে একাদশ সাজায় তারা। কিন্তু বোলারদের জন্য তো পর্যাপ্ত রসদই দিতে পারল না ব্যাটসম্যানরা।
প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের চারজন দুই অঙ্ক ছুঁলেও কেউ পারেননি ২০ রানও করতে। ধুঁকতে ধুঁকতে ১১০ রানেই শেষ ইনিংস।
এই রান তাড়ায়ও নিউ জিল্যান্ড ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে ৫০ করার আগেই। তবে জিমি নিশাম ও মিচেল স্যান্টনারের জুটি তাদেরকে উদ্ধার করে বিপর্যয় থেকে।
৪৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে যখন তারা জয়ের কাছে, ১৪.৪ ওভারে রান ৫ উইকেটে ৯৫, বৃষ্টিতে তখন বন্ধ হয় খেলা। ম্যাচের সমাপ্তিও সেখানেই।
২০ বলে ২৮ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন নিশাম। তবে জয়ের মূল নায়ক স্যান্টনার। ব্যাট হাতে অপরাজিত ১৮ রানের ইনিংসের আগে ৪ ওভারে স্রেফ ১৬ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে নিউ জিল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কই ম্যাচের সেরা।
বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামে টসে হেরে। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে আগের ম্যাচের মতো এ দিনও বাংলাদেশ পায়নি লিটন কুমার দাসকে। রনি তালুকদারের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন সৌম্য সরকার।
সবার আগে বিদায় নেন সৌম্যই। ম্যাচের তৃতীয় বলে হাফ ভলি পেয়ে মিড অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে চার মারেন তিনি। পরের বলেই এলবিডব্লিউ হয়ে যান সুইং করে ভেতরে ঢোকা বলে। রিপ্লেতে দেখা যায়, বল কোনোরকমে স্পর্শ করছিলেন লেগ স্টাম্পের বাইরের অংশ।
নাজমুল হোসেন শান্ত তিনে নেমে দৃষ্টিনন্দন এক স্ট্রেট ড্রাইভে চার মেরে শুরু করেন। পরের ওভারে টানা দুটি চার মারেন তিনি অ্যাডাম মিল্নকে। এরপর বাউন্ডারি আদায় করেন তিনি বেন সিয়ার্সের বলেও।
প্রথম ১২ বলে স্রেফ চারটি স্কোরিং শট ছিল তার, চারটিই বাউন্ডারি।
তার ইনিংস থামে পঞ্চম ওভারে। মিল্নকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারার চেষ্টায় ক্যাচ দেন তিনি পয়েন্টে। ১৫ বলে ১৭ রানে থামে বাংলাদেশ অধিনায়কের ইনিংস।
তখন কে জানত, ওই ইনিংসই হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ!
পরের ওভারে রনি এলবিডব্লিউ হয়ে যান বেন সিয়ার্সের বলে। উইকেটে সঙ্গী তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলে রিভিউ না নিয়ে চলে যান তিনি। একটু পর টিভি রিপ্লেতে ফুটে ওঠে, বল চলে যাচ্ছিল লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে। অথচ বাংলাদেশের দুটি রিভিউ তখনও অক্ষত!
পাওয়ার প্লেতে ৩ উইকেট হারালেও ৪৫ রান তুলতে পারে বাংলাদেশ।
কিন্তু মিচেল স্যান্টনার ও ইশ সোধি আক্রমণে আসার পর দিশা হারায় বাংলাদেশের ইনিংস। এক পাশ থেকে বেশ আঁটসাঁট বোলিং করেন লেগ স্পিনার সোধি। বাঁহাতি স্পিনার স্যান্টনার দারুণ লাইন-লেংথের সঙ্গে গতি বৈচিত্রের মিশেলে শুধু রানই আটকাননি, একের পর এক শিকারও ধরেন।
শুরু করেন তিনি আফিফ হোসেনকে দিয়ে। ক্যারিয়ারে নানা সময়েই পর্যাপ্ত ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান না বলে তাকে নিয়ে আলোচনা প্রায়ই। এ দিন ক্রিজে যান ষষ্ঠ ওভারে। বড় ইনিংস খেলার অবারিত সুযোগ তাই ছিল। কিন্তু আলগা শটে সুযোগ হারিয়ে বিদায় নেন ১৩ বলে ১৪ রান করে।
হৃদয় দুটি চার মারলেও ১৬ রান করতে বল খেলেন ১৮টি। একবার জীবন পেয়ে শামীম হোসেন ৯ রান করেন ১৪ বলে। ভালো কিছু করতে পারেননি শেখ মেহেদী হাসানও। তাদের সবাইকেই অস্বস্তিতে ভুগিয়ে শেষ পর্যন্ত বিদায় করে ছাড়েন স্যান্টনার।
৮১ রানে ৭ উইকেট হারানো বাংলাদেশের তখন একশ নিয়েই টানাটানি।
লোয়ার অর্ডারদের টুকটাক অবদানে শেষ পর্যন্ত তারা তিন অঙ্ক ছুঁতে পারে। তবে পুরো ২০ ওভার খেলতে পারেনি।
দুর্দান্ত ইয়র্কারে রিশাদ হোসেনকে বোল্ড করে ইনিংস গুটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন মিল্ন।
রান তাড়ায় প্রথম ওভারেই তানভির ইসলামের কাছ থেকে দুটি ‘উপহার’ পান ফিন অ্যালেন। দু্ই শর্ট বলের প্রথমটি ছক্কা হয়নি সামান্য একটুর জন্য, পরেরটি ঠিকই আছড়ে পড়ে সীমানার ওপারে।
তবে ম্যাচের রঙ বদলে যায় দ্রুতই। দুই প্রান্তেই স্পিন দিয়ে শুরু করে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওভারে মেহেদিক রিভার্স সুইপ খেলার চেষ্টায় বিদায় নেন বিপজ্জনক টিম সাইফার্ট। অনিয়মিত কিপার হয়েও বেশ ক্ষীপ্রতায় স্টাম্পিং করেন রনি।
এরপর কিউইদের চেপে ধরে বাংলাদেশ। মেহেদিকে তুলে মারতে গিয়ে মিড অফে ধরা পড়েন ড্যারিল মিচেল। ভেতরে ঢোকা দারুণ ডেলিভারিতে গ্লেন ফিলিপসের বেলস উড়িয়ে দেন শরিফুল।
আরেকটি উইকেট ধরা দেয় সৌভাগ্যের ছোঁয়ায়। দ্বিতীয় রান নেওয়ার চেষ্টায় ক্রিজের মাঝ বরাবর ধাক্কা খেয়ে আটকে যান দুই ব্যাটসম্যান। নন স্ট্রাইক প্রান্তে যখন মার্ক চ্যাপম্যানকে রান আউট করছেন মুস্তাফিজুর রহমান, আরেক ব্যাটসম্যান অ্যালেন তখন ব্যথায় মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন।
নিজেকে সামলে নিয়ে সেই অ্যালেন পরের ওভারে রিশাদকে ছক্কায় ওড়ান বাজে বল পেয়ে। কিন্তু পরের ওভারেই তার দৌড় থামিয়ে দেন শরিফুল। ফিলিপসকে আউট করার মতোই আরেকটি দুর্দান্ত ভেতরে ঢোকা ডেলিভারি ছোবল দেয় স্টাম্পে। ৩১ বলে ৩৮ রান করে ফেরেন অ্যালেন।
এই নিয়ে সিরিজের তিন ম্যাচের প্রতিটিতেই শরিফুলের বলে আউট হলেন তিনি। বাংলাদেশে বিপক্ষে সবশেষ ৬ টি-টোয়েন্টিতেই তিনি এই বাঁহাতি পেসারের শিকার!
নিউ জিল্যান্ডের রান তখন ৫ উইকেটে ৪৯। স্কোরকার্ডের চেহারা বেশ অদ্ভুত, প্রথম ব্যাটসম্যানের রান ৩৮, পরের চারজনের সবার ১!
বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান ছিল না কিউইদের। আর একটি উইকেট দ্রুত নিতে পারলেই জয়ের পথে অনেকটা এগিয়ে যেত বাংলাদেশ। কিন্তু জিমি নিশাম ও মিচেল স্যান্টনারের জুটি ভাঙতে পারেনি তারা।
স্বভাবসুলভ আগ্রাসী ব্যাটিংয়েই দলকে পথে ফেরান নিশাম। দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখে আক্রমণে আসা অনিয়মিত স্পিনার শান্তকে টানা দুই বলে ছক্কা-চার মারেন তিনি। পরে ছক্কায় ওড়ান রিশাদকেও। তাতে দলের রান পৌঁছে যায় জয়ের ঠিকানায়।
বে ওভালে এই প্রথম জিতল পরে ব্যাট করা দল।
শেষটা ভালো না হলেও এবারের নিউ জিল্যান্ড সফর থেকে খালি হাতে ফিরছে না বাংলাদেশ। কিউইদের বিপক্ষে তাদের মাঠে প্রথমবার ওয়ানডে জয়ের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টিতেও প্রথম জয়ও ধরা দিয়েছে এবার। সঙ্গে আরও প্রাপ্তি, ভব্যিষ্যৎ সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়ার রসদ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ১৯.২ ওভারে ১১০ (সৌম্য ৪, রনি ১০, শান্ত ১৭, হৃদয় ১৬, আফিফ ১৪, শামীম ৯, মেহেদি ৪, রিশাদ ১০, শরিফুল ৪, তানভির ৮, মুস্তাফিজ ৩*; সাউদি ৪-০-২৫-২ , মিল্ন ৩.২-০-২৩-২, সিয়ার্স ৪-০-২৮-২, স্যান্টনার ৪-০-১৬-৪, সোধি ৪-০-১৬-০)।
নিউ জিল্যান্ড: ১৪.৪ ওভারে ৯৫/৫ (অ্যালেন ৩৮, সাইফার্ট ১, মিচেল ১, ফিলিপস ১, চ্যাপম্যান ১, নিশাম ২৮*, স্যান্টনার ১৮*; তানভির ১-০-১২-০, মেহেদি ৪-০-১৮-২, শরিফুল ৩.৪-০-১৭-২, মুস্তাফিজ ৩-০-১৩-০, রিশাদ ২-০-১৯-০, শান্ত ১-০-১৪-০)
ফল: ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে নিউ জিল্যান্ড ১৭ রানে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজ ১-১ ড্র।
ম্যান অব দা ম্যাচ: মিচেল স্যান্টনার।
ম্যান অব দা সিরিজ: শরিফুল ইসলাম।