এক দক্ষিণ আফ্রিকানের ‘হাতে’ দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়

ঐতিহাসিক জয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শেষ করল নেদারল্যান্ডস।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2022, 09:43 AM
Updated : 6 Nov 2022, 09:43 AM

পেসার ব্র্যান্ডন গ্লভারের শর্ট বলে ডেভিড মিলারের পুল করার চেষ্টায় টাইমিং হলো না ঠিকমতো। বল উঠে গেল আকাশে। শর্ট ফাইন লেগে দাঁড়ানো রুলফ ফন ডার মেরওয়া উল্টো ঘুরে বলের দিকে চোখ রেখে দৌড় দিলেন স্কয়ার লেগের দিকে। সূর্যের আলো তখন তার মুখের দিকে। প্রায় ২০ গজ পেছনে দৌড়ে শেষ মুহূর্তে তিনি স্লাইড করে বল জমালেন মুঠোয়। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত ওপরে তুলে ছুঁড়লেন হুঙ্কার। ম্যাচের ভাগ্যও যেন লেখা হয়ে গেল সেখানেই।

কিপার ও অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। নিশ্চিতভাবে আসরের সেরা ক্যাচগুলির তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে এটি।

ফন ডার মেরওয়ার ওই ঝলকের আগে ভালোভাবেই ম্যাচে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২৯ বলে দরকার ছিল ৪৭ রান, হাতে ৬ উইকেট। মিলারের মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের সঙ্গে ক্রিজে হাইনরিখ ক্লাসেন। কিন্তু এই ক্যাচের পর পাল্টে যায় সব। ওই ওভারেই আরেকটি উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেল প্রোটিয়ারা।

শেষ পর্যন্ত তারা হেরে গেল ১৩ রানে। শুধু কি তাই? শেষ হয়ে গেল যে তাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই!

অথচ অ্যাডিলেইডে রোববার এই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে সমীকরণ ছিল সহজ। জিতলেই মিলে যাবে সেমি-ফাইনালের টিকেট। উল্টো তাদের হারিয়ে বড় অঘটনের জন্ম দিল নেদারল্যান্ডস। পেল ঐতিহাসিক জয়। যেকোনো সংস্করণেই দক্ষিণ আফ্রিয়ার বিপক্ষে ডাচদের প্রথম জয় এটি। সেটি এলো আবার বিশ্ব মঞ্চে।

যেখানে বড় অবদান ফন ডার মেরওয়ার ওই দুর্দান্ত ক্যাচের। সেই ফন ডার মেরওয়া, যিনি ২০০৯ ও ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে। সেই তিনিই দক্ষিণ আফ্রিকাকে এবারের আসর থেকে ছিটকে দিতে রাখলেন বড় ভূমিকা।

ফন ডার মেরওয়ার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেকও দক্ষিণ আফ্রিয়ার হয়ে।

মূলত তিনি বাঁহাতি স্পিনার ও আগ্রাসী মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। যদিও তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল কিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিপিং সামর্থ্যের জন্যই তাকে নেওয়া হয়েছিল ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকা দলে। পরে হয়ে যান স্পিনার।

২০০৯ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন ফন ডার মেরওয়া। এই সময়ে খেলেন ১৩টি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি।

এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা দলে জায়গা হারিয়ে ফেলেন তিনি। আর মিলছিল না সুযোগ। তিনি খুঁজতে থাকেন নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার সুযোগ।

অবশেষে সেই সুযোগ এসে যায় ২০১৫ সালে। ফন ডার মেরওয়ার মা একজন ডাচ। সেই সূত্রে ওই বছর তিনি পেয়ে যান ডাচ পাসপোর্ট।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগও পান ওই বছরের জুলাইয়ে। নেদারল্যান্ডসের হয়ে অভিষেক হয় নেপালের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। সেই ম্যাচে তিনি ছয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে খেলেন ২৭ বলে অপরাজিত ৪০ রানের ঝড়ো ইনিংস। পরে হাত ঘুরিয়ে ২৭ রানে নেন ২ উইকেট। ম্যাচটি যদিও হেরে যায় ডাচরা।

এরপর থেকে নেদারল্যান্ডসের হয়ে নিয়মিত খেলছেন ফন ডার মেরওয়া। দলটির হয়ে এর মধ্যে টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ৩৯টি। ওয়ানডে তিনটি।

নেদারল্যান্ডসের হয়ে ২০১৬ ও ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলেন ফন ডার মেরওয়া। দুই আসরেই নেদারল্যান্ডস বিদায় নেয় প্রাথমিক পর্ব থেকে। ফন ডার মেরওয়ার নিজের পারফরম্যান্সও তেমন ভালো ছিল না।

২০১৬ আসরে দুই ম্যাচে ব্যাটিং পেয়ে তিনি করেন ৩ রান। সেবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে অবশ্য ১ ওভারে ৩ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে অবদান রাখেন তিনি। একটি উইকেট নেন বাংলাদেশের বিপক্ষেও।

গত বছরের আসরে নেদারল্যান্ডস হেরে যায় ৩ ম্যাচেই।  ফন ডার মেরওয়া দুটিতে আউট হন শূন্য রানে, একটিতে করেন ৬। বল হাতে পাননি কোনো উইকেট।

অস্ট্রেলিয়া আসরটাও ব্যাট হাতে ফন ডার মেরওয়ার ভালো কাটল না। ব্যাটিংয়ে একবার আউট হন শূন্য রানে, একবার ৫ রানে। দুটিতে অবশ্য শূন্য রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি।

তবে বোলিংটা খারাপ করেননি। প্রথম ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ৩ ওভারে ১৯ রান দিয়ে নেন একটি উইকেট। নামিবিয়ার বিপক্ষে ১ ওভারে ৬ রান দিয়ে তার প্রাপ্তি ছিল একটি। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে উইকেট না পেলেও ৩ ওভারে রান দেন কেবল ১৬।

সুপার টুয়েলভ পর্বে পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ওভার করে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়ে তিনি রান দেন যথাক্রমে ৭ ও ৮।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের সুযোগ হয়নি তার। বল হাতে নিয়ে ২ ওভারে রান দেন ১৯।

তবে তিনি ঝলক দেখালেন ফিল্ডিংয়ে। তার ওই এক ক্যাচেই যেন বিদায়ঘন্টা বেজে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার!

ওই ওভারে দুটিসহ ম্যাচে স্রেফ ৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে জয়ে বড় অবদান রাখা গ্লভারের জন্মও ফন ডার মেরওয়ার মতো জোহানেসবার্গে। তিনিও দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে।

এই ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের হয়ে আরও দুজন খেলেছেন যাদের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায় - স্টেফান মাইবার্গ ও কলিন আকারম্যান।

৩০ বলে ৩৭ রানের ইনিংসে দেড়শ ছাড়ানো সংগ্রহের ভিত গড়ে দেন ওপেনার মাইবার্গ। তিনে নেমে ২৬ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ৪১ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা আকারম্যান।

শেষের স্মরণীয় জয়ের মতো পুরো আসরটা এবার দারুণ কেটেছে নেদারল্যান্ডসের। প্রাথমিক পর্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নামিবিয়াকে হারিয়ে তারা পা রাখে সুপার টুয়েলভ পর্বে।

এখানে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে তারা হেরে যায় স্রেফ ৯ রানে। এরপর বড় ব্যবধানে হারে ভারত ও পাকিস্তানের কাছে।

তবে, পরের ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দেয় তারা ৫ উইকেটে। পরের ম্যাচেই মিলল আরেকটি জয়, এবার শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।

ডাচরা এর আগে একবারই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্ব পেরিয়ে পরের রাউন্ডে খেলেছিল। ২০১৪ সালে সুপার টেন পর্বে চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দিয়েছিল তারা। এবার তাদের কাছে ধরাশায়ী হলো দক্ষিণ আফ্রিকা।