টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট শ্রীধরন শ্রীরামের ঘরের মাঠ এটি, এখানকার কন্ডিশন-উইকেট সম্পর্কে তার কাছ থেকে ধারণা নিয়ে নিউ জিল্যান্ডকে হারানোর আশায় বাংলাদেশ দল।
Published : 12 Oct 2023, 10:47 PM
প্যাড-গ্লাভস পরে নাজমুল হোসেন শান্ত তখন নেটে ঢোকার অপেক্ষায়। তার দিকে এগিয়ে গেলেন শ্রীধরন শ্রীরাম। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন দুজন। এরপর ‘ফিস্ট বাম্প’ করে শ্রীরাম চলে গেলেন মেহেদী হাসান মিরাজের নেটে। এভাবে নেট থেকে নেটে বেশ ছুটোছুটি করতে দেখা গেল তাকে। এমনিতে অনুশীলনে তাকে বেশ সক্রিয় দেখা যায় প্রতি সেশনেই। তবে এই ম্যাচের আগে তার তৎপরতা একটু বেশিই থাকার কথা। তার কাছে প্রত্যাশাও যে এখানেই বেশি!
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযানে শ্রীরামকে টেকনিক্যাল পরামর্শক হিসেবে যুক্ত করার একটি বড় কারণ ভারতের বিভিন্ন মাঠ, কন্ডিশন ও উইকেটগুলো সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ও গভীর জ্ঞান। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে খেলেছেন তিনি ১৮ বছরের বেশি। ধারণা তার থাকারই কথা। তার সেই অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগার কথা নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে চেন্নাইয়ের এই ম্যাচেই। শ্রীরাম যে চেন্নাইয়েরই সন্তান!
এই শহরে তার জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা ও ক্রিকেটের পথে এগিয়ে চলা। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে এই এমএ চিদাম্বারাম স্টেডিয়ামেই তার অভিষেক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে। তামিলনাড়ুর হয়ে তো বটেই, ক্লাব ক্রিকেটসহ আরও সব ধরনের ক্রিকেটে এই মাঠে তিনি অনেক খেলেছেন। এখানকার সব কিছু হাতে তালুর মতোই চেনা তার।
যদিও কোচিং ক্যারিয়ারে দীর্ঘদিন তিনি কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে আইপিএলে ডাগ আউটে দেখা যায় তাকে নিয়মিতই। তাই এই মাঠের, এই উইকেটের মৌলিক চরিত্র তার যেমন জানা, তেমনি জানেন সাম্প্রতিক ধরনও। এমন একজনকে নিজেদের ড্রেসিংরুমে পাওয়া মানে অমূল্য অভিজ্ঞতার আলোয় স্নাত হওয়ার সুযোগ।
বিশেষ করে, এই ম্যাচের জন্য। সেমি-ফাইনালের পথরেখা আঁকার সময় যে ম্যাচগুলিকে স্বপ্নের সম্ভাব্য বৈতরণি ভেবে রেখেছিল বাংলাদেশ, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি নিশ্চিতভাবেই সেখানে ছিল। শ্রীরামকে তাই এই ম্যাচেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রতিনিধি হয়ে এসে নাজমুল হোসেন শান্তও বললেন, শ্রীরামকে পেয়ে উপকৃত হচ্ছে দল।
“উনি অনেক সহায়তা করছেন। ধারামশালায় আমরা যে দুটি ম্যাচ খেললাম, ম্যাচের আগে উইকেট সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন প্রত্যেক ব্যাটসম্যান-বোলার সবাইকে। এখানে (চেন্নাইয়ে) আসার আগেই এখানকার উইকেট কেমন হবে, সে সম্পর্কে আমাদের আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে, আমরা অনেক সাহায্য পাচ্ছি তার কাছ থেকে। আশা করব, সামনের যে ম্যাচগুলো আছে, উনি এভাবে সহায়তা করবেন।”
আইপিএলে এই মাঠে ৫টি ম্যাচ খেলেছেন সাকিব আল হাসান। মাঠ সম্পর্কে ধারণা কিছু নিশ্চয়ই আছে তারও।
তবে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ ও ধারণা নেওয়া এক ব্যাপার, মাঠে তা বাস্তবায়ন করা ভিন্ন ব্যাপার। পরিকল্পনা তো কিছু প্রতি ম্যাচেই থাকে। মাঠে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেই না গড়বড় হয়!
এমনিতে এই ম্যাচের পরিকল্পনায় ‘স্পিন’ থাকার কথা অনেকটা জুড়ে। স্পিন দিয়ে কিউইদের কাবু করা এবং তাদের স্পিন সামলানো, দুটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ।
এই মাঠের উইকেট বরাবরই স্পিনারদের দিকে সহাতার হাত বাড়িয়ে দেয়। চিরায়ত সেই চরিত্র যে এবারও অটুট, তা ফুটে উঠেছে কদিন আগে অস্ট্রেলিয়া-ভারত ম্যাচে। শুষ্ক উইকেটে সেদিন অস্ট্রেলিয়াকে নাকাল করে ছেড়েছেন ভারতীয় স্পিনাররা।
বাংলাদেশ-নিউ জিল্যান্ড ম্যাচ সেই উইকেটে নাকি ভিন্ন ২২ গজে, তা জানা যায়নি। তবে আগের ম্যাচটি থেকেই দল আশার রসদ খুঁজছে বলে ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে জানালেন বাংলাদেশের সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
“আমরা এর আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দেখেছি। উইকেটটা স্পিন নির্ভর ছিল। আমার মনে হয়, আমাদের স্পিনারদের অনেক সাহায্য করে এটা। তবে উইকেট নিয়ে খুব বেশি ভাবছি না। আমাদের পরিকল্পনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের কী করতে হবে, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।”
এই উইকেটে বাংলাদেশ কেমন পরিকল্পনা সাজাতে পারে, সেটির স্পষ্ট ধারণা আছে নিশ্চয়ই নিউ জিল্যান্ড দলেরও। প্রস্তুতিও সেভাবেই নেওয়ার কথা তাদের। স্পিন করা বা স্পিন খেলার শক্তি-সামর্থ্যেও তারা কম যান না কোনো দলের চেয়ে। ইশ সোধি, মিচেল স্যান্টনার, রাচিন রবীন্দ্রকে নিয়ে গড়া তাদের স্পিন আক্রমণ দারুণ কার্যকর। প্রয়োজনে অবদান রাখার জন্য গ্লেন ফিলিপস তো আছেনই। উপমহাদেশে ও আইপিএলে নিয়মিত খেলায় কিউই ব্যাটসম্যানরাও এখন আর স্পিনের সামনে খুব নড়বড়ে নয়।
এই ম্যাচে বড় একটি ইতিবাচক দিক তাদের এমনিতেও থাকছে। চোটের দীর্ঘ ধাক্কা কাটিয়ে আট মাস পর কেন উইলিয়ামসন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরছেন এই ম্যাচ দিয়ে। শুধু প্রেরণাদায়ী অধিনায়কই নন তিনি, স্পিনের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক ব্যাটসম্যানও। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের গুঁড়িয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করার পর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও বড় জয় পেয়ে কিউইরা এমনিতে উড়ছে। নিয়মিত অধিনায়ককে ফিরে পেয়ে তাদের আরও উজ্জীবিত হওয়ার কথা। তাদের বরং মধুর সমস্যা, উইলিয়ামসন ফেরায় বাদ দেওয়া হবে কাকে!
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য বাংলাদেশকে বেশ সমীহই দেখালেন উইলিয়ামসন।
“উপমহাদেশে ওরা এই কন্ডিশনের সঙ্গে অভ্যস্ত এবং তাদের দলে ম্যাচ উইনারও আছে বেশ কজন। এছাড়া সবসময়ই আমি বলি যে, বিশ্বকাপের মতো জায়গায় যে কোনো দল যে কাউকে হারাতে পারে।”
উইকেট ও কন্ডিশনের কারণে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থকবে নিশ্চিতভাবেই। তবে এই দলের সমস্যার জায়গাও তো কম নেই। ওপেনিং জুটি দলকে গড়ে দিতে পারছে না শক্ত ভিত। নতুন বলে পেসাররা দলকে এনে দিতে পারছেন না ব্রেক থ্রু বা দ্রুত উইকেট। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শুরুতে পিছিয়ে পড়েও পরে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানো গেছে। কিন্তু ইংল্যান্ড সেই সুযোগ দেয়নি। পিছিয়ে পড়লে ফেরার সুযোগ দেবে না নিউ জিল্যান্ডও।
সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে তাই ব্যাটে-বলে শুরুর সমস্যার সমাধান জরুরি। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টাও জরুরি।